কভিড-১৯ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও ওয়াশ খাতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানটি সবার জন্য পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি বিশেষত পানি ও সাবানের ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই কভিডের দ্বিতীয় ঢেউসহ অন্য উপসর্গ ধ্বংস করতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ওয়াশ খাতে তাত্ক্ষণিক বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
আসন্ন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) খাতে বরাদ্দের বিষয়ে বাজেটপূর্ব এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গত রবিবার এ দাবি জানানো হয়।
এ সময় বক্তারা মহামারির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের জন্য পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিনে আরও বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত দেন।
ওয়াটারএইড, ইউনিসেফ, পিপিআরসি, ফানসা-বিডি, এফএসএম নেটওয়ার্ক, স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার ফর অল, ওয়াশ অ্যালায়েন্স ও এমএইচএম নেটওয়ার্কের যৌথ উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এতে বক্তারা বলেন, জনসমাগমস্থল, হাট-বাজার, বাস টার্মিনাল, সরকারি ও বেসরকারি অফিসসহ দেশের বড় শহরগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য হাত ধোয়ার স্থানে পানি, হ্যান্ড ওয়াশ বা সাবানের ব্যাপক স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শহর কিংবা গ্রামের পাশাপাশি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয় কার্যকরী নানা সুযোগ-সুবিধাসহ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, কভিড-১৯ অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। তারা স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার উপকরণ জোগানে সামর্থ্য হারিয়েছে। বিশেষ করে, নারীরা মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে। আসন্ন বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনে অতিরিক্ত ভ্যাট এবং ট্যাক্স কর্তন এবং তা সামর্থ্যের মধ্যে রাখার জন্য মূল্য হ্রাস করা বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অবশ্যই জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬ অর্জনের জন্য ২০২১-২০২২ জাতীয় বাজেটে যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে। চলমান মহামারির কারণে ওয়াশ খাতে বাজেটের ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। এসব অসমতা দূর করে আগামী জাতীয় বাজেটে ওয়াশ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজিএস) অর্জনের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, হাইজিনের বিষয়টি এখনও স্বাস্থ্য খাতের একটি সাব-সেক্টর হয়ে রয়ে গেছে। এ কারণে বরাবরই এ খাতে বরাদ্দ কম দেয়া হয়। তবে চলতি বছর এ খাতে যথাযথভাবে মনোযোগ না দেয়া হলে মহামারী আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
ওয়াটারএইড ও ইউনিসেফের সহযোগিতায়, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কারণ ওয়াশ খাতে ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এ সময় ২ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১২ হাজার ২২৭ কোটি টাকা হয়েছে। বিগত বছরগুলোর বাজেটে এ খাতে আর্থিক বরাদ্দের ধারা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপির অধীনে ওয়াশ খাতে ৫ শতাংশেরও কম বরাদ্দ করা হয়েছিল।
বক্তারা জানান, ভৌগলিক অবস্থান বিচারে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াশ বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রয়েছে অসমতা। গ্রামাঞ্চল, চর, পার্বত্য অঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় ওয়াশ বাজেট বরাদ্দের অত্যধিক প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোয় শহর ও মহানগরগুলো তুলনামূলকভাবে বরাদ্দের শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মিকস জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের উন্নত স্যানিটেশনের সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত জ্ঞান যথেষ্ট থাকলেও হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধির চর্চার হার খুব কম।
জেএমপির ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষের হাত ধোয়ার স্থানে সাবান ও পানির সুবিধা রয়েছে। দেশে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত ধারণা যথেষ্ট থাকলেও এর চর্চা কম। সবার জন্য হ্যান্ড হাইজিনের প্রয়োজনের পাশাপাশি দেশব্যাপী এর প্রচারণারও চালানো দরকার বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়।
সুপারিশ
* চলমান এ কভিড-১৯ মহামারি ওয়াশ নিয়ে নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে নতুন ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে । সুনির্দিষ্টভাবে কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধিকে শুধু মূলধারার এজেন্ডায় ফুটনোটে না রেখে এর সামগ্রিকতা বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধিতে ব্যাপকভাবে আলোকপাত করতে হবে।
* কিশোরী মেয়ে ও শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি ও স্বাস্থ্য এবং অপুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলির ব্যাপারে পদক্ষেপগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
* কভিড-১৯-এর বাস্তবতা এবং টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন প্রসারের জাতীয় কৌশলপত্র পরিমার্জন ও হালনাগাদ করা প্রয়োজন।
* স্বাস্থ্যবিধিকে মূলধারার আনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির ইস্যু ও অনুশীলনগুলোকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় পর্যায়েই গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
* জনসমাগম স্থল এবং মার্কেট/বাজার, সরকারি এবং বেসরকারি অফিস-আদালতে হাত ধোয়ার সুবিধা (হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশন) তৈরি এবং সেগুলোর কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত সম্পদের আরোহন ও যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।
* কভারেজের ব্যবধান কমিয়ে আনতে ওয়াশখাতের বরাদ্দের ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক বৈষ্যম্য ও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের পক্ষপাতের বিষয়টি দূর করতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২০-২০২৫ অনুসরণে হাত ধোয়া এবং অন্য স্বাস্থ্যবিধি চর্চার মাধ্যমে সামগ্রিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি পরিস্থিতির উন্নয়নে বহু-খাত ও সংস্থাভিত্তিক উদ্যোগ এগিয়ে নিতে বাজেটের ফোকাস বাড়াতে হবে।
* পানি-বিষয়ক পরিবেশগত এবং ঝুঁকি নিরসনমূলক কর্মসূচিগুলো ভালো উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা নিয়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য পরিবেশবান্ধব সৌরচালিত পানি লবনমুক্ত করার প্ল্যান্ট চালু এবং এসব এখন যেগুলো আছে সেগুলোর কাজ অব্যাহত রাখার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা।
উল্লেখিত সব তথ্য ডাউনলোডের জন্য drive.google.com অথবা drive.google.com লিংকে ক্লিক করতে পারেন।
প্রেস কনফারেন্সটি দেখতে ক্লিক করতে পারেন এখানে us02web.zoom.us, অ্যাকসেস পাসকোড: *Zc8eWP4 ♦