সরকারের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়েছেন জ্যাক মাসহ অনেক জায়ান্ট

0

চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশে সফলতার প্রতিশব্দ যেন জ্যাক মা। ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। বনে যান উদ্যোক্তা। তার জীবন যেন রূপকথার মতো। পাথেয় দেশ থেকে দেশান্তরে। তরুন ও উচ্চাকাঙ্খীদের কাছে জ্যাক মা আদর্শের অপর নাম।

জ্যাক মা বর্তমানে চীনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন আলিবাবা। মার্কিন টেক জায়ান্ট আমজনের প্রতিদ্বন্দী এ প্রতিষ্ঠানটি।

চীনে ‘ড্যাডি মা’ হিসেবেও পরিচিত জ্যাক মা। আর্থিক ও আত্মিক সব ক্ষেত্রে তার দৃপ্ত পদচারণ চোখে পড়ে। যেমন ২০১৭ সালে শীর্ষস্থানীয় চীনা অভিনেতাদের সঙ্গে একটি শর্ট ফিল্মে অপরাজেয় কুং ফু মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। চীনা পপ গায়িকা ফায়ি ওংয়ের সঙ্গে গানও গেয়েছেন তিনি। চীনের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী জেং ফাংঝির সঙ্গে তার আঁকা ছবি সোথবাই নিলামে ৫৪ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে চীনে তার জনপ্রিয়তা বোঝানো সম্ভব নয়। দেশটির মানুষের মনিকোঠায় ছিলেন জ্যাক মা। ছিলেন এই অর্থে যে, সে মহাতারকার পতন ঘটেছে!

চীনের অনেকের কাছে জ্যাক মা ভিলেন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। তার ব্যাপারে দেশটির জনসাধারণের অভিমত অনেকটা বদলে গেছে। তাকে অপছন্দ করাটা যেন ট্রেন্ডি হয়ে উঠেছে। ‘ভিলেন’, ‘ইভল ক্যাপিটালিস্ট’, ‘ব্লাডসাকিং ঘোস্ট’ ইত্যাদি তকমা পাচ্ছেন তিনি। চীনের একজন লেখক মা’র ‘১০টি মারাত্মক পাপ’-এর তালিকা তৈরি করেছেন। মার্ক্সের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছেন জ্যাম মা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে।

সাধারন মানুষের মনে জ্যাক মা’র প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারন দেশটির সরকার। তার প্রতি চীনা সরকারের বিরূপ আচরণ লক্ষ করা গেছে। আর এতেই জনমনে তাকে নিয়ে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সাপে নেউলের মতো। অথচ ২০১৬ সালে প্রথম চীনা ব্যক্তি হিসেবে জ্যাক মা ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

কয়েক সরকারি কর্মকর্তা সম্প্রতি জানিয়েছেন, তারা আলিবাবার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছেন।

আলীবাবার পাশাপাশি জ্যাক মা’র অ্যান্ট গ্রুপকেও নজরে রেখেছে সরকার। আলিবাবার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার দিন অ্যান্ট গ্রুপের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা দেখা করবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অনলাইনে চীনের সবচেয়ে বড় আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এটি। ২০০৩ সালে তার প্রতিষ্ঠিত আলিপে আজকের অ্যান্ট গ্রুপ। অ্যান্ট আলীবাবার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। 

আর এ ঘটনার কারণে অনেক মানুষ অনুভব করছে, জ্যাক মা’র মতো সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে না। চীনে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিলিয়নেয়ারের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে দেশটির প্রায় ৬০ কোটি মানুষের মাসিক আয় ১৫০ ডলার বা তারও কম। চলতি বছরের ১১ মাসে দেশটির সামগ্রিক ব্যয় ৫ শতাংশ কমে গেছে। অথচ বিপরীত চিত্রটি চটকদার- বিলাসদ্রব্যের পেছনে গতবছরের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়ালেখা করে আসা শিক্ষার্থীরাও  চাহিদা অনুযায়ী চাকরি খুঁজে পেতে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নত শহরগুলোয় থাকার ব্যবস্থা করাই ব্যয়বহুল হয়ে পরেছে। অ্যান্ট গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেয়া তরুণ জনগোষ্ঠী এখন ঋণ নেয়ার জন্য অনুতাপে ভুগছে।

চিত্রগুলো চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের মধ্যেই ধনীদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশও প্রকট করে তুলেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও এ অসন্তোষের পক্ষে রয়েছে। বিষয়টি নি:সন্দেহে চীনের উদ্যোক্তা ও বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের।

চীনে চলতি বছরের বার্ষিক অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কিত সভায় পুঁজির অস্বাভাবিক বিস্তার রোধে তদন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর দ্বন্দ্বে শি জিন পিংয়ের অবস্থানও পরিস্কার। অ্যান্ট গ্রুপের সঙ্গে বিবাদ চলাকালে ঝাং জিয়ান নামের এক শিল্পপতির সম্মানে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন শি। ঝাং শি’র  জন্মস্থান গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সেখানে। যা হোক, অনুষ্ঠানে ব্যবসার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যে জাতির জন্যও কাজ করতে হবে এমন বার্তা দিয়েছেন শি। তিনি সভায় ঝাং জিয়ানকে অনুসরণ করে তার মতো দেশপ্রেমিক হওয়ার পরামর্শ দেন সবাইকে। তবে ঝাং জিয়ান যে দেউলিয়া হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন, এ বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

জ্যাক মা’রও কিছু অনুদানমূলক প্রকল্প রয়েছে। চীনের গ্রামাঞ্চলে তার কিছু উদ্যোগসহ আফ্রিকায় উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প রয়েছে তার। তবে জ্যাক মা ও ঝাং জিয়ানের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে দেয়া শক্তিশালী মন্তব্যের জন্য জ্যাকের খ্যাতি রয়েছে। অনেক সময় তিনি কৌশলে তাকে শায়েস্তা করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সরকারকে। এমনও বলেছেন, “আলিপে’র জন্য কাউকে জেলে যেতে হলে নাহল আমিই যাবো।” অ্যান্ট গ্রুপের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ব্যাপারে বলেছিলেন, সরকারের দরকার হলে আমি এটি (অ্যান্ট গ্রুপ) সরকারকে দিয়ে দিতে পারি।

তার এসব বিস্ফোরক মন্তব্য সত্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের বিজনেস স্কুলের অর্থনীতিবিদ ঝিউ চেন জানান, অ্যান্ট গ্রুপের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়বে অথবা এর বেশিরভাগ অংশ সরকারি মালিকানাধীন হবে এমন সম্ভাবনাও আছে।

চীনা সরকারের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রন কৌশলে পরিবর্তন দেখা গেছে। মূলত জ্যাক মা’র ওপর কড়াকড়ি আরোপের ফলে এ পরিবর্তন এসেছে। দেশটিতে সবসময়ই নানা কনটেন্ট সেন্সর করা হতো। আবার অবাধ বাণিজ্যের ব্যবস্থাও রয়েছে। এক্ষেত্রে বাঁধা নিষেধও ছিল স্বল্প পরিমাণে। সরকার পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানও এ কাজে যুক্ত হয়নি। তবে শুরুতে চীনের ইন্টারনেটভিত্তিক শিল্পের ক্ষেত্রও ছোট ছিল।

বর্তমানে গুগল, ফেসবুকের চেয়ে বেশি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে আলিবাবা ও টেনসেন্ট। মার্কিন টেক জায়ান্টগুলোর মতো চীনা টেক জায়ান্টগুলোও ক্ষুদ্র প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। এ কারনে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টার পেছনের কারন বুঝতেও বেগ পেতে হয়না। বিশেষজ্ঞরা এমনই বলছেন।

রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিঘ্ন না করে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যায় দেশটির বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। অনেক প্রযুক্তি সংস্থা মানুষকে ট্রাক করতে সরকারকে সহায়তাও করে থাকে। তারপরও প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা ও প্রভাবকে হুমকি হিসেবে দেখছে চীনা সরকার।

অথচ টেক জায়ান্টগুলোই যে চীনে একচেটিয়া ব্যবসা করছে এমন নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জরুরিসেবা ব্যবসার প্রভাব তুলনামূলক বেশি।

পেকিং ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ ঝাং ওয়েইয়িং বলেছেন, চীনা মোবাইল ফোন, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য আছে। কেননা সরকারি অনুমতি ছাড়া আপনি এক্ষেত্রে কাজই করতে পারবেন না। তার এ সংক্রান্ত লেখা কিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলে তা দ্রুত সেন্সর করে দেয়া হয়।

জ্যাক মা ও বড় টেক জায়ান্টগুলোর বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রকদের সিদ্ধান্ত কতদূর গড়াবে তা বলা কঠিন। ব্যবসা-বাণিজ্যে অব্যাহত চাপ বহাল রয়েছে। চীনের অবাধ বাণিজ্যের সমর্থকরা মনে করছেন, ১৯৫০’র দশকের দিকে পেছনে হাঁটতে যাচ্ছে চীন।

ইতিমধ্যে সরকারের রোষানলে আলীবাবার শেয়ারে ৮ শতাংশ দরপতন হয়েছে। গত জুলাইয়ের পর যা সর্বনিম্ন। এর আগে অ্যান্টের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি) কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির বিরুদ্ধে নিয়ামক সংস্থার বিধিমালা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানির দুরাবস্থায় চীনের সেরা ধনী মা’র ব্যক্তিগত সম্পদেও ভাটা দেখা দিয়েছে। ব্লুমবার্গ জানায়, ৬২ বিলিয়ন থেকে তার সম্পদ নেমে এসেছে ৪৯.৩ বিলিয়ন ডলারে।

আলিবাবা
বহুজাতিক ই-কমার্স, পাইকারি, তথ্যপ্রযুক্তি বিপননকারী গ্রুপ, ১৯৯৯ সালে যাত্রা করে। ক্রেতা-ক্রেতা,ব্যবসায়ী-ক্রেতা, ব্যবসায়ী-ব্যবসায়ী পন্য কেনাবেচার ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সেবা দিয়ে থাকে।

বিশ্বের শীর্ষ ১০ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি আলীবাবা। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আলিবাবা দ্বিতীয় এশিয়ান প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কেট মূল্য অতিক্রম করে।

প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ আরব্য রজনীর আলীবাবা চরিত্র থেকে করা হয়েছে। 

Share.