মহান বিজয় দিবসে বিলেতে এক বাংলাদেশির বিজয়ের খবরই বটে! বাংলাদেশি কোচ শহিদুল আলম রতনের নাম জুড়ে গেল ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক ভেন্যু দি ওভালের নামের সঙ্গে। প্রতীকী সম্মান হিসেবে ‘কিআ শহিদুল আলম রতন ওভাল’ নামটি এ স্টেডিয়ামে থাকবে ২৪ ঘণ্টা।
ইংল্যান্ডের সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ ওভাল। সারের সঙ্গে খ্যাতনামা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিআ’র স্পন্সরশীপ চুক্তি অনুযায়ী মাঠটির নাম অনেকদিন ধরে ‘কিআ ওভাল’। গতকাল মঙ্গলবার তাদের ওয়েবসাইটে একদিনের জন্য এ নামের সঙ্গে রতনের নাম জুড়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
ইতিহাস গড়া এ সম্মানের পেছনের গল্পটি বেশ মনকাড়া। ‘ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট’ নামের একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান নির্বাহী রতন। সংস্থাটি ইংল্যান্ডের হাজারো বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারী নানা সংস্থা থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময় সংস্থাটি নেয় দারুণ উদ্যোগ ‘ন্যাশনাল লটারি ফাউন্ডেশনের’ অনুদান নিয়ে তারা লন্ডন ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের তৃণমূল পর্যায়ের ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়ায়।
পুরো কার্যক্রম পরিচালনায় ছিলেন রতন। পুরস্কার হিসেবে ন্যাশনাল লটারি ও সারে কাউন্টি ক্লাব রতনকে এ সম্মান দিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোচ ও উদ্যোক্তা রতন বলেছেন, ‘ন্যাশনাল লটারি ও সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব আমাকে বেছে নেওয়ায় আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। আজ ১৫ ডিসেম্বর আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার ক্রিকেটীয় কার্যক্রমের পেছনে যারা সমর্থন যুগিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’
সারের ক্রিকেটার আমির ভিরদি আর রায়ান প্যাটেল জানান, রতনে উদ্যোগের কারণে প্রচুর তরুণ ক্রিকেটার উপকৃত হয়েছেন।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে চাকরি করেছেন রতন। কাজ করেছেন হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, ‘এটা অনেক বড় সম্মান। আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না। এটা আসলে অনেক বড় অনার। তবে আমি বলবো, এটা আমার একার সম্মান নয়। আমি বলবো, এটা আমার একার নাম নয়। এটা বাংলাদেশের নাম। আমি আজ একজন বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত।’
রতন আপাদমস্তক বাংলাদেশী। ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। খেলেছেন ওয়ারী থেকে মোহামেডান, নিয়মিত ছিলেন ঢাকার ক্রিকেটে। এমসিসির হয়ে আন অফিশিয়াল বাংলাদেশ জাতীয় দলেও খেলেছেন। অল্প বয়সে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ক্রিকেট ছেড়ে দ্রুত কোচিংয়ে নামেন। ইংল্যান্ড থেকে কোচেস কোর্স তিন লেভেল সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে দেশে ক্লাব ক্রিকেটে কোচিং শুরু করেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চাকরি ছেড়ে চলে যান মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়া যুব দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে কাজ করেন। মালয়েশিয়া থেকে তাকে লন্ডনে নিয়ে যায় ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট। শুরুতে তাদের গেম ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা ও কোচ হিসেবে কাজ করলেও কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন প্রধান নির্বাহী হিসেবে।
সংস্থার দায়িত্ব নিয়ে রতন ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ইংল্যান্ডের তৃনমূল পর্যায়ে। নিজেদের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা সারে, মিডলসেক্সসহ বিভিন্ন কাউন্টি ক্লাবের সাথে কাজ করি। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্রিকেটের সাথে রাখার জন্য অলাভজনক সংস্থা হিসেবে কাজ করি।’ এ কাজটিই তারা জোরদার করেন লকডাউনের সময়।
ইংল্যান্ডের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, লেবাননে সুবিধাবঞ্চিত ক্রিকেটাররা তাদের সুবিধা নিয়েছে।
লকডাউনে নিজেদের কাজ নিয়ে রতন বলছিলেন, ‘সময়টা অল্পবয়সী ক্রিকেটারদের জন্য কঠিন ছিলো। হতাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো। আমরা তাই ওদের জন্য নানা ধরণের অনলাইন ক্লাস ও কোর্স নিয়ে এলাম। আমরা ধীরে ধীরে এটা লন্ডনের বাইরে, এমনকি ইংল্যান্ডের বাইরেও ছড়িয়ে দিলাম। আমাদের ফান্ড দিচ্ছিলো ন্যাশনাল লটারি। কোচিং দলকে বলেছি, এমনভাবে কোচিং সেটআপ করতে, যেটা যেনো যে কোনো ঘরেই করা সম্ভব হয়।’
রতনের এ কর্মকান্ডের প্রশংসা করেছে ইংল্যান্ডের ক্রীড়া বিভাগ। আর রতন যখন এইসব কথা বলছিলেন, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিলো কিআ ওভালের নতুন নাম ফলকটা। যেনো সেখানে রতনের নাম লেখা নেই। লেখা রয়েছে- দি বাংলাদেশ ওভাল।
রতন এখন বাংলাদেশ।
দি ওভাল
ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের কেনিংটনে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ ওভাল। ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট খেলাগুলো এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্যবসায়িক অংশীদারত্বের কারণে এটি বর্তমানে কিআ ওভাল নামে পরিচিত। অতীতে স্টেডিয়ামটিকে মাঝে-মধ্যে কেনিংটন ওভাল নামে ডাকা হতো।
কয়েক বছর আগে এর নাম ফস্টার্স ওভাল, এএমপি ওভাল, ব্রিট ইন্স্যুরেন্স ওভাল নামে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি ঘটানো হয়েছিল মূলত বাণিজ্যিক অংশীদারি চুক্তির কারণে।
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত মাঠগুলোর একটি ওভাল। ১৮৮০ সালে এ মাঠে নিজ দেশে প্রথম টেস্ট খেলে ইংল্যান্ড। ওভাল মাঠটি সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের নিজস্ব মাঠ নামে পরিচিত টেস্ট ক্রিকেটের জন্যে ব্যবহৃত ওভাল মাঠটি যুক্তরাজ্যে প্রথম ও বিশ্বের দ্বিতীয় মাঠ হিসেবে স্বীকৃত। প্রথমস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বা এমসিজি।
১৮৭২ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত সি ডব্লিউ অ্যালকক সারে ক্রিকেট দলের সচিব থাকাকালীন ১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি ওভালে অনুষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার খেলায় অস্ট্রেলিয়া দি অ্যাশেজ টেস্টে দুই দিনের মধ্যে ৭ রানে জয়লাভ করেন। তখন দি স্পোর্টিং টাইমস ইংলিশ ক্রিকেটের দূরবস্থা দেখে ছদ্ম শোকবার্তা প্রকাশ করে, যা পরবর্তীকালে অ্যাশেজ ট্রফির প্রবর্তন ঘটায়। এখনো ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে টেস্ট খেলাগুলো অ্যাশেজ ট্রফি নামে পরিচিত। ১৮৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিলি মারডক ওভালে প্রথম দ্বি-শতক হাঁকান।
দ্বিতীয় দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল ১৯০৭ সালে ওভালে খেলতে আসে। ১৯২৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৩১ সালে নিউজিল্যান্ড দল এখানে খেলে। ৫ম সফরকারী দল হিসেবে ১৯৩৬ সালে ভারতীয় দল এখানে খেলে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান ও ১৯৯৮ সালে শ্রীলঙ্কা খেলে। আরো পরে আসে জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ দল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওভালকে যুদ্ধবন্দীদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। ♦