যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড নীতি সুদহার আপাতত ৫ শতাংশই রাখছে। অর্থাৎ নীতি সুদ হার বাড়ায়নি ফেডের মুদ্রানীতি কমিটি। এর মধ্য দিয়ে এক বছরের বেশি সময় পর ফেড নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থেকে সরে এল। খবর: এনবিসি।
এর আগে ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ফেড ধারাবাহিকভাবে মোট ১০ বার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে নীতি সুদহার ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু গত বছর বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বারবার নীতি সুদহার বাড়ায় ফেড।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে ফেড খুবই কঠোর। তাই তারা বলেছে, মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশামতো আরও না কমলে নীতি সুদহার আবার বাড়ানো হতে পারে।
ফেডের ওপেন মার্কেট কমিটি বলেছে, মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি। কমিটি চায় মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনতে, কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে কোনো ঝুঁকি চিহ্নিত হলে কমিটি নীতি সুদহার আবার সমন্বয় করতে পারে।
একই সঙ্গে ফেড বেকারত্বের পূর্বাভাসও কমিয়ে দিয়েছে, যা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বেকারত্বের হার না বাড়িয়েও তারা এভাবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে যেতে পারে।
মূল বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতির সূচক নিম্নমুখী হওয়া। পরিসংখ্যান বিভাগ এক ঘোষণায় জানিয়েছে, ২০২২ সালের জুনে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, গত মে মাসে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৪ শতাংশে নেমেছে।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফল সর্বত্র ব্যাপক। এতে একদিকে বন্ডের সুদহার বদলে যায়, বস্তুত নীতি সুদহারের চেয়ে বন্ডের সুদহার কম থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডের সুদহার পরিবর্তিত হলে সারা বিশ্বের আর্থিক বাজারেও তার প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ করপোরেট ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার বেড়ে যায়। গত এক বছরে ১০ বার নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে এসব সুদহার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কমে এলেও সমাজে অর্থের প্রবাহ কমে যায়। এতে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলোয় এখনই সেই ধারা দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান নিয়ে সমস্যা ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, গত মে মাসে বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগার পূর্বাভাস দিয়েছে। ব্যাংকের ঋণ, বাড়ির দাম ও স্টকের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। সে জন্য ফেডের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থেকে বেরিয়ে আসার বিশেষ কারণ নেই।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব ক্লিভল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট লরেটা মেস্টার বলেছেন, আমি এমন কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না যে ফেডের নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থামানো উচিত। বরং তা আরও বৃদ্ধির জোরালো কারণ আছে।
তবে শেষ পর্যন্ত এবার নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থেকে বেরিয়ে এল ফেড, অপরিবর্তিত থাকল নীতি সুদহার। তবে নীতি সুদহার কমানো হবে, এমন কথাও তারা বলেনি। আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, কঠোর মুদ্রানীতির ফল অর্থনীতিতে অনুভূত হতে কিছুটা সময় লেগে যায়।
এডওয়ার্ড জোনসের বিনিয়োগ কৌশলবিদ অ্যাঞ্জেলো কোরকাফাস বলেন, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে বেকার ভাতার জন্য আবেদন বাড়ছে, মোট শ্রমসময় কমে যাচ্ছে ও এমনকি ঠিকা শ্রমিকের চাহিদাও কমে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব শিকাগোর প্রেসিডেন্ট অস্টান গুলসবি বলেন, সম্ভবত ফেডের নীতি সুদহার বৃদ্ধির পুরো ফল এখনো টের পাওয়া যায়নি।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের যে দুটি ব্যাংক ধসে পড়ল, তার পেছনে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব ছিল। বিষয়টি হলো, ঋণপত্র বা বন্ডের দাম সুদহারের বিপরীত। অর্থাৎ সুদহার বাড়লে বন্ডের দাম কমে, আর সুদের হার কমলে বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো, বন্ড যখন কেউ কেনেন, তখন তাতে নির্দিষ্ট হারে সুদের প্রতিশ্রুতি থাকে। এরপর বাজারে সুদের হার বাড়লে কেউ যদি আগের বন্ড অন্যের কাছ থেকে একই দামে কেনেন, তা হলে আগের হারে সুদ পাবেন, যা বাজারে চলতি সুদহারের চেয়ে কম।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) নগদ জোগানের ভারসাম্যের তোয়াক্কা না করে বন্ডে দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। আমেরিকার বাজারে তখন নীতি সুদহার প্রায় শূন্য; কোভিডও আসেনি, লকডাউন বা লাগাম ছাড়া মূল্যস্ফীতিও ছিল না। সমস্যার শুরু হলো লকডাউন-উত্তর ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে।
এসভিবি ঠিক এ কারণেই বিপদে পড়ে, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফেড নীতি সুদহার বাড়াতে থাকলে এসভিবির কেনা বন্ডের দাম কমতে থাকে। ফলে স্থিতিপত্রে তাদের মুনাফা কমতে থাকে। ৮ মার্চ ব্যাংকটি বন্ডে বিনিয়োগ বাবদ ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতির কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এরপর আমানতকারীরা রাতারাতি তাদের জমা টাকা এই ব্যাংক থেকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেন। এরপরই ব্যাংকটির পতন ঘটে। ♦