রক্তে পাওয়া ভাষা আর সাহিত্যচর্চা কম হয় না। বেশি চলে ফেব্রুয়ারিতে। হিড়িক লেগে যায় এ সিজনে। এমন এবারও হয়েছে। চলুক মহামারী, কী অতিমারী . . .। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অনেক বই এসেছে। লিখেছেন দেশের অনেক লেখক। আর তা প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা। তবে ‘সব’ আর ‘কেউ কেউ’-এর ভেতর পার্থক্য আছে।
‘আবরার জনতা’ বইটির লেখক মো: সামিন রহমান ও প্রকাশনা সংস্থা এমপ্যাথি নেশন এই ‘কেউ কেউ’-এর কাতারে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে এ বছর ২৬ মার্চ।
পড়া শুরুর আগে বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখকের আলোকচিত্রে দেখতে পাই সাভারের অনবদ্য স্থাপনা ও জাতির গৌরবের মহান স্মৃতি সৌধের সামনে দাঁড়ানো লেখক। এতে পাঠক হিসেবে প্রচ্ছন্নভাবে ধারণা জন্মে শিক্ষক ও লেখক মো: সামিন রহমান স্বাধীনতার ৫০ বছরে এর যথার্থতা খুঁজে পেতে চান।
বইয়ের ফ্ল্যাপের পরে প্রথম পাতাটি সবুজ রঙের। তাতে লেখা একটি কোটেড বাক্য। ‘দি ওয়ার্ডস আর বিউটিফুল বাট অ্যাকশনস আর সুপ্রিম’। কার কথা তার উল্লেখ নেই। নেট ঘেটে জানতে পাই যুগে যুগে কালে কালে বিপ্লবের প্রতিশব্দ সত্ত্বা রূপে যিনি বিরাজ করছেন সেই আর্নেস্তো চে গুয়েভারার কথা এটি।
মূলত এই বই ১৫টি গল্পের। বইয়ের শেষে আছে একটি ইশতেহার। গল্প, উপন্যাস কম হলেও জীবনে কিছু পড়া হয়েছে। তাই মনে হয় প্রথমে ইশতেহারটি পড়ি। ১৯১ পৃষ্ঠার বইয়ের ১৮০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত এই ইশতেহার। তা পড়ে স্পষ্ট হয় লেখকের ‘অ্যাকশন’-এর জরুরত।
জর্জ অরওয়েল লিখিত ‘নাইন্টিন এইটিফোর’ উপন্যাসের পাল্টা এক ছবি যেন চিত্রিত এই ‘সহমর্মী দেশ ইশতেহার’ ও ‘এমপ্যাথি ন্যাশন ম্যানিফেস্টো’ তে। মানুষে মানুষে ভালোবাসা অন্যায় নয়- এমন এক সহমর্মী দেশ ও পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন যেন লেখকের মনে।
লেখক মো: সামিন রহমানের স্বপ্নের দেশটি এমন- যে দেশে বা পৃথিবীতে ট্যাক্সের বালাই নাই। ভোটাভুটি ও দলাদলির কাহিনি নেই। একটি আইনই সবাই মেনে চলবেন তাহলো- জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে ও কর্মযজ্ঞে সহমর্মিতা অনুশীলন করতে হবে। কেউ সবটুকু ভালো নয়, কেউ সবটুকু খারাপ নয়। লেখকের এমপ্যাথি নেশন প্রস্তাবনায় দেশের কোনো সীমানা নেই। নেই পাসপোর্ট। সেখানে জম্পেশ শিল্প সাহিত্য চর্চা চলে।
আসর করে সবাই সাহিত্য পড়ে, গান গায়, বাদ্য বাজায়। সেদেশের মিডিয়া সুন্দর সুখী খবরগুলো সামনে তুলে আনে, উৎসাহ দেয়। বিচারকরা সহমর্মী। দোষীও সহমর্মী।
ডাক্তাররা চিকিৎসার সময় নিজেকে রোগীর জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করেন। উঠতে বসতে ওষুধ কোম্পানির দালালি করেন না। ফায়দা লুটেন না। এদেশে খুন, ধর্ষণ নেই। কাকে খুন করবে? কাকে ধর্ষণ? নিজেকে অপরের জায়গায় বসালে তো এসব সম্ভব নয়।
সে দেশের উদ্যোক্তা ও নীতি নির্ধারকরা এমনভাবে বাজার, অর্থনীতি, পণ্য, সেবা সাজান যাতে সবার কল্যাণ হয়। এর ওটা বুঝ দিয়ে, ওর এটা মেরে দিয়ে, কাউকে পেছনে লাথি মেরে নয়। সব সমমর্মী ভাবনার এ পৃথিবী, এ দেশ।
শিক্ষক ও লেখক মো: সামিন রহমান ৭টি বিষয়ে প্রস্তাবনা হাজির করেন। এগুলোর মধ্যে আছে, ১. শিল্প, সাহিত্য ও মিডিয়া। ২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। ৩. নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন। ৪. জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ। ৫. রাষ্ট্র, শাসন ও বিচার ব্যাবস্থা। ৬. উদ্যোক্তা ও অর্থনীতি। ৭. শিক্ষা, সমাজ ও সম্পর্ক। এই ৭টি ক্ষেত্রই ‘শত্রুকে ভালোবাসো, তার হৃদয় জয় করে নাও’ মন্ত্রে উজ্জীবিত।
প্রস্তাবক লেখক সংগ্রাম চান শুধু শিল্পে। সেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন, আমাদের আজকের শিল্প সাহিত্য কি আমাদের ভাবায়? ভেতরে আঘাত করে? অনুপ্রাণিত করে? ভয়ের পাহাড় ভেঙে ফেলতে পারে? মহৎ যজ্ঞে আমাদের কি একতাবদ্ধ করে?
শিক্ষক ও লেখক পরিচয়ের বাইরে এসে তখন মো: সামিন রহমানকে চিনি একজন মায়াবী লড়াকু হিসেবে। যিনি বইয়ের শেষ পাতায় নিজের ঠিকানা দিয়ে লেখেন, ‘মানুষকে একীভূত করার কোনো চিন্তা যদি আপনার মনে থাকে তবে যোগাযোগ করুন . . .।’ অগাধ এক শ্রদ্ধা মনে নিয়ে এরপর আবার বইয়ের শুরুতে যাই।
আবরার জনতা বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, তিনজন আবরারকে। এই তিন আববার হলেন, বিইউপির আবরার। বুয়েটের আবরার ও ডিআরএমসির আবরারকে।
বাংলাদেশের সংবাদ পাঠক, দর্শক ও নাগরিকদের কাছে এই তিন আবরারই পরিচিত ও তাঁদের সংবেদশীলতা ছুঁয়ে যায় তাঁদের অপমৃত্যুর কারণে। এক আবরার নিহত জেব্রা ক্রসিংয়ে বাস চাপায়। আরেক আবরারের মৃত্যু নৃশংস। সবশেষ আববার নিহত হন দেশের প্রথম সারির পত্রিকা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।
বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন চার গুণী ব্যক্তিত্ব। অতলস্পর্শী জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বীর মুুক্তিযোদ্ধা মো: কেফায়েত উল্লাহ নজিব, কথা সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব।
লেখক তাঁর ভাষ্যে জানান, ১৫টি গল্পে তিনি শুধু দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তাহলো- মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্ম যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সংগ্রামগুলো স্বচোখে দেখেনি সেই তরুণ, আবেগী জনতার সংগ্রাম কী হবে? আর এত সংগ্রামে পাওয়া বাংলাদেশ এখন কেমন আছে? লেখক ইতিহাস পাঠে উৎসাহী কিন্তু লক্ষ্য ইতিহাস সৃষ্টি। যেমনটা সাচ্চা বিপ্লবীরা হয়ে থাকেন তেমনই।
মো: সামিন রহমান লিখিত সব গল্পে বর্ণিত হয়েছে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস, প্রকৃতি প্রেম, এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন মানব মানবীর প্রেম, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইত্যাদি।
লেখক মো: সামিন রহমান সর্বব্যাপি প্রভাব রাখে তাঁর গল্প গল্পে। সিরিয়ায় গণহত্যা, ভারতে মোদী শাসন, উত্তর কোরিয়ার কিম রাজত্ব ও দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- সব উন্মোচিত তাঁর সহজ বর্ণনায়। ভবিষ্যত দ্রষ্টা তিনি সাইন্স ফিকশনের বিবরণে। কিন্তু তিনি ইতিহাসকেও আবার ভুলে যান না।
‘আবরার জনতা’ বইয়ের প্রচ্ছদকার আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। প্রতিটি গল্প ইলাস্ট্রেশনে ঠাঁসা। এ কীর্তি সাদি এমদাদের। ২৫০ টাকা দামের বইটি মুদ্রিত হয়েছে স্টারলিং প্রিন্টিং প্রেসে।
সব মিলে প্রথম বই হলেও গল্পে গল্পে মো: সামিন রহমান প্রমাণ রাখেন তাঁর প্রজ্ঞার। তরুণ প্রবীণ নির্বিশেষে অনুপম পাঠযোগ্য এই বই। আর তাঁর সমমর্মী ইশতেহার? এ মহামারীর উপলব্ধি শেষের পৃথিবীকে হয়তো হাঁটতে হবে সে মঙ্গল পথেই।
::: হাসান শাওন
লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ♦