পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রত্যাশিত বিষয়। এ দক্ষতার মূলে থাকে ভাষা। কেননা কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কাছাকাছি পৌঁছার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো তাদের মানুষগুলো যে ভাষায় কথা বলে, তাদের সঙ্গে সে ভাষাতেই কথা বলা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা দ্বিধায় বিচরণের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষা উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এর মাধ্যমেই কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের মানুষ পুরোদস্তুর পরিণত হতে পারে বিশ্ব নাগরিকে।
উন্নত ক্যারিয়ারের জন্য বিদেশি ভাষা জানা অপরিহার্য একটি বিষয়। বিশ্বায়নের গতিশীলতায় বহুজাতি সংস্কৃতিগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সম্প্রদায়গুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠছে একে অপরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যৎ বিশ্ব নেতাদের চিহ্নিত করার জন্য শিক্ষার্থীদের যাচাই-বাছাই করে বিভিন্নভাবে। নিয়োগকর্তারা এমন লোক খোঁজেন, যাঁরা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। ফলে নির্দিষ্ট দেশের ভাষা আয়ত্তে একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি চাকরি ক্ষেত্রেও মেলে বিস্তর সুযোগ–সুবিধা। তেমনি কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষার কথা নিয়ে আজকের আয়োজন।
মান্দারিন
গত দুই দশকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মান্দারিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় পরিণত হয়েছে। উৎপাদন ও রপ্তানিশিল্পে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগের উদ্ভব হওয়ায় মান্দারিনে দক্ষতার চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য অভাবনীয় শিল্পের মধ্যে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিন্যান্স ও লজিস্টিকস। মান্দারিন চায়নিজ চীন ও তাইওয়ানের ৮১০ মিলিয়নের বেশি মানুষের মাতৃভাষা। ভাষাটি ইন্দোনেশিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইনেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সেই সূত্রে সিভিতে মান্দারিন ভাষার সংযোজন যেকোনো প্রার্থীর মান উন্নত করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে মান্দারিন চায়নিজ ভাষা শেখানো হয়। এ ছাড়া বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান চীনা ভাষা শেখায়।
জাপানিজ
১২০ মিলিয়নের বেশি জাপানিজ ভাষাভাষী মানুষের দেশ জাপান। দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, ইলেকট্রনিকস ও অটোমোবাইল শিল্পের অত্যন্ত উন্নত স্তরের। সুতরাং গেজেট–সম্পর্কিত যেকোনো ব্যবসার জন্য জাপানিজ ভাষা শেখা অবধারিত। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ম্যানুফ্যাকচার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লজিস্টিকসে চাকরির সুযোগের জন্য প্রাসঙ্গিক শিল্প-মান দক্ষতার সঙ্গে জাপানিজ ভাষা দক্ষতার অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট জাপানিজ ভাষা শেখার জন্য সেরা জায়গা।
জার্মান
ইউরোপকেন্দ্রিক ক্যারিয়ারে সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে জার্মান ভাষা শেখা। জার্মান ১০০ মিলিয়নের বেশি লোকের ভাষা। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, লিচেনস্টাইন, লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ডেও ব্যাপকভাবে জার্মান বলা হয়। ইউরোপের অর্থনীতিতে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। এখানে ফিন্যান্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচার, ডিজাইন বা ফার্মাসিউটিক্যালস ক্ষেত্রগুলোতে পেশাদারের চাহিদা প্রচুর। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে জার্মান শেখার বিস্তর সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশের জার্মান দূতাবাস স্বীকৃত গোথ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।
তুর্কি
বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৭৭ মিলিয়ন মানুষের মাতৃভাষা তুর্কি, যা একে বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি সর্বাধিক কথ্য মাতৃভাষায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তুরস্ক ছাড়াও তুর্কিভাষী আছে বলকান, ককেশাস ও পশ্চিম ইউরোপে। তুর্কি অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশটি বাস করেন জার্মানিতে, যেখানে জার্মানির পর তুর্কি দ্বিতীয় সর্বাধিক কথ্য ভাষা। এখানে প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, এনার্জি, ট্যুরিজম, ফিন্যান্স, আইন, ব্যবসার মতো বৈচিত্র্যময় ভাতে অসংখ্য ক্যারিয়ারের সুযোগ বিদ্যমান। পাবলিক খাতে কর্মজীবনে আগ্রহীদের জন্য কূটনীতি, বুদ্ধিমত্তা ও সামরিক ক্ষেত্রগুলোতে সক্রিয়ভাবে নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি এবং ফেলোশিপেরও ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে তুর্কি শেখার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট।
স্প্যানিশ
বিশ্বব্যাপী ৪৮০ মিলিয়নের বেশি স্থানীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে স্প্যানিশ ২১টি দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এটি মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগের গেটওয়ে। এখানে মানবসম্পদের সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে মিডিয়া ও ব্যাংকিংয়ে। পাশাপাশি চিকিৎসা, সামাজিক, শিক্ষা এবং বিপণনেও বেশ ভালো সুযোগ আছে। শতকরা ৮৫ ভাগ আমেরিকান নিয়োগকর্তা স্প্যানিশকে সবচেয়ে বেশি চাহিদাযুক্ত বিদেশি ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। অনেকটা ইংরেজির মতো হওয়ায় সহজে যে কেউ স্প্যানিশ রপ্ত করতে পারেন। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট খণ্ডকালীন ও দীর্ঘ মেয়াদে স্প্যানিশ ভাষা শেখা যায়।
কোরিয়ান
দক্ষিণ কোরিয়া হলো বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। প্রতিবছর হাজার পর্যটক এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের মিলনমেলা দেশটি। এটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানিকারক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার। গত দশ বছরে কোরিয়া এশিয়ায় অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বিটিএস, কোরিয়ান-পপ, কোরিয়ান-ড্রামা এবং কোরিয়ান ফ্যাশনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে উত্থান হয়েছে কোরিয়ান ওয়েভের। এ ছাড়া কোরিয়া ডিজিটাল প্রযুক্তি শিল্পের নেতৃস্থানীয় শক্তি এবং ইন্টারনেট-সংযুক্ত সমাজের সঙ্গে সবচেয়ে উদ্ভাবনী দেশগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে কোরিয়ান শেখার সুযোগ আছে।
ফরাসি
বিশ্বরাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে হলে বা আফ্রিকাভিত্তিক শিল্পে কাজ করতে আগ্রহীদের জন্য ফরাসি ভাষা অবশ্যই প্রথম পছন্দ হতে হবে। ফরাসি ভাষা ২৯টি দেশের মোট ২২০ মিলিয়নের বেশি লোকের কথ্য ভাষা। আফ্রিকাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভাষাটির দ্রুত প্রসার লাভ করছে। কানাডাতেও এর ব্যবহার রয়েছে। ফরাসি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সংস্থা এবং পরিচালনা পর্ষদ যেমন জাতিসংঘ, ন্যাটো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ফুটবল ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অ্যাসোসিয়েশনের (ফিফা) ভাষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফরাসি ভাষা শেখা যেতে পারে।
আরবি
তৈলশিল্প, জ্বালানি খাত বা হাই-অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের কর্মীদের জন্য আরবি ভাষা দক্ষতা আবশ্যক। বিশ্বের ২৭টি দেশে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন আরবি ভাষাভাষী লোক আছে। এই একটি ভাষা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ক্যারিয়ার তৈরির সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষা শিক্ষা হতে পারে উন্নত ক্যারিয়ারের সেরা মাধ্যম। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসার আধিক্য থাকায় প্রচুর সুযোগ আছে আরবি শেখার। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ভালো মানের দুটি আরবি ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র।
ইতালিয়ান
ইতালিয়ান ইতালিসহ সান মারিনো, সুইজারল্যান্ড ও ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এটি ৬৫ মিলিয়ন লোকের মাতৃভাষা। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ইতালীয় অভিবাসী এবং তাঁদের বংশধরদের সংখ্যা প্রায় কয়েক মিলিয়ন। ফ্যাশন, ডিজাইন, চারুকলা ও সংস্কৃতি, খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন এবং বিতরণ, ফুটবল, বিলাসবহুল গাড়িশিল্প, এমনকি ভ্যাটিকান ক্যারিয়ারের জন্য ইতালিয়ান শ্রেষ্ঠ ভাষা। এখানে ইতালিয়ান ভাষা বলা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে ফিয়াট, ফেরারি, ল্যাম্বোর্গিনি ও আর্মানির মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোতে। বাংলাদেশে ইতালিয়ান ভাষা শেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে।
রাশিয়ান
বিশ্বব্যাপী ২৫০ মিলিয়ন রাশিয়ান ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই বাস করে রাশিয়ায়। অন্যরা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র যেমন ইউক্রেন, লাটভিয়া ও কাজাখাস্তানের বাসিন্দা। রাশিয়ার ক্রমবিকশিত অর্থনীতির নেপথ্যে রয়েছে এর শক্তিশালী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সরবরাহ, খনি এবং তৈল ও জ্বালানি খাত। জার্মানির মতো রাশিয়াও বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত পেশাগুলোতে জনপ্রিয়, তাই যেকোনো উদীয়মান বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদের জন্য রাশিয়া স্বর্গ হতে পারে। রাশিয়ান ভাষার জন্য উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র।