সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের সিংহভাগ শেয়ার অধিগ্রহণের অনুমোদন পেয়েছে পুঁজিবাজাবারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বিনিয়োগকারীদের এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছর জানুযারিতে সানোফি বাংলাদেশের বেশিরভাগ শেয়ার অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে সানোফির শেয়ার অধিগ্রহণের অনুমোদন পেয়েছে বেক্সিমকো।
এর আগে গত জানুয়ারিতে বেক্সিমকো ফার্মার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের যে ৫৪ দশমিক ছয় শতাংশ শেয়ার সানোফি গ্রুপের হাতে ছিল, তা কিনতে চুক্তি করেছে তারা।
সানোফি বাংলাদেশের এ শেয়ার অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে ৩৫ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড।
সানোফি বাংলাদেশের বাকি ৪৫ দশমিক চার শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের হাতে।
সে সময় জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেইন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের ছাড়পত্র এবং ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থ লেনদেনের অনুমতি পেলেই সানোফির সঙ্গে চূড়ান্ত ক্রয় চুক্তি করবে বেক্সিমকো। সেজন্য তিন থেকে ৯ মাস সময় লাগতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এ অধিগ্রহণের ফলে বেক্সিমকো হূদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, চর্মরোগ চিকিত্সার ওষুধ ও ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণের মাধমে নিজেদের উপস্থিতি ও অবস্থান আরও দৃঢ় করতে পারবে।
১৯৫৮ সালে ‘মে অ্যান্ড বেকার’ নামে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানি সানোফি। পরে ২০০৪ সালে সানোফি-অ্যাভেন্টিস গ্রুপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির নাম বদলে সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড রাখা হয়।
সানোফি অধিগ্রহণের এ সংবাদ প্রকাশের পর গতকাল ডিএসইতে বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারদর দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ বা ১০ পয়সা কমে প্রতিটি সর্বশেষ ২০৬ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হয়, যার সমাপনী দরও ছিল একই। দিনভর শেয়ারদর সর্বনিম্ন ২০৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২১১ টাকা ২০ পয়সায় ওঠানামা করে।
এক বছরের মধ্যে শেয়ারদর ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২১৬ টাকা ৯০ পয়সায় ওঠানামা করে।
২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাববছরে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে তারা। আলোচিত সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে আট টাকা ৬৭ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকা ১২ পয়সা।
আগের বছর একই সময়ে যা ছিল যথাক্রমে সাত টাকা ৪৮ পয়সা ও ৭২ টাকা ৯৬ পয়সা।
‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিটি ১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
এর রিজার্ভের পরিমাণ দুই হাজার ২৭৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
-বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস-
বাংলাদেশের ওষুধ রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউক্যিালস লিমিটেড।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে উন্নত ও আধুনিক ওষুধ সরবরাহ করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।প্রতিষ্ঠানটি ‘বেক্সিমকো ফার্মা’ নামে সমধিক পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ ও ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ।
বেক্সিমকো ফার্মায় বর্তমানে ৫০০’র বেশি ক্যাটাগরির ওষুধ রয়েছে। মানবদেহের উপকারী ও সুস্বাস্থ্যের বিধানে নানা ধরনের ওষুধ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। উৎপাদনের সব পর্যায়ে বৈশ্বিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয় এখানে। ওষুধ তৈরিতে শতভাগ মান নিশ্চিত করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে। সেরা মানের সঠিক পণ্য তৈরি করে থাকে তারা। দেশ ও দেশের বাইরের গ্রাহকের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এখানে। সংগত কারণে আস্থা অর্জনের পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরিণত হয়েছে সফল ফার্মাসিউটিক্যালসে।
১৯৭৬ সালে উৎপাদনে আসে বেক্সিমকো ফার্মা। মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৮০ সালে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওষুধ তৈরি শুরু করে। ১৯৮৩ সালে নিজস্ব ফরমুলেশন ব্র্যান্ড চালু করে।
১৯৮৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে ওষুধের উপকরণ (এপিআই) প্রস্তুত শুরু করে। ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় ফরমুলেশন পণ্য বিক্রি শুরু করে। প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৩ সালে অ্যান্টি-রিট্রোভাইরাল (এআরভি) ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। ২০০৫ সালে প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের (এলএসই) অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে (এআইএম) তালিকাভুক্ত হয়। ক্লোরোফ্লোরো কার্বনমুক্ত এইচএফএ ইনহেলার চালু করে। এ ধরনের ইনহেলারের প্রবর্তন শুরু হয় বেক্সিমকোর কল্যাণে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মেনে চলে বেক্সিমকো ফার্মা। মেডিক্যাল ডিভাইস উৎপাদনে গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়। তাই অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জিসিসিভুক্ত দেশ, ব্রাজিল, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ।
২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার থেরাপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (টিজিএ) জিএমপি অ্যাক্রিডিটেশন সার্টিফিকেট পায়। একই বছরে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর গালফ সেন্ট্রাল কমিটি ফর ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অ্যাক্রিডিটেশনও অর্জন করে। পরের বছর ব্রাজিলের জিএমপি অনুমোদন পায়।
২০১০ সালটি বেক্সিমকো ফার্মার জন্য একটি মাইলফলক বলা যায়। এ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটির নানা ওষুধ।
২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার জিএমপি অ্যাক্রিডিটেশন পায়। প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে সালবুটামোল এইচএফএ ইনহেলার রফতানি করে। ২০১৩ সালে ইউরোপের বাজারে চক্ষুসংক্রান্ত পণ্য রফতানি শুরু করে। ২০১৪ সালে তাইওয়ানের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএফডিএ) ও হেলথ কানাডার জিএমপি অনুমোদন লাভ করে। ওই বছরে অস্ট্রেলিয়া ও রোমানিয়ায় ওষুধ রফতানি শুরু হয় তাদের।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) জিএমপি অনুমোদন পায়। ওই সময় কুয়েতের বাজারে প্রবেশ করে তারা। পঞ্চমবারের মতো ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি (গোল্ড) অর্জন করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মালয়েশিয়ার বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওষুধ তৈরির কারখানা নির্মাণ করে। বাংলাদেশের বাইরে এটিই বেক্সিমকোর প্রথম যৌথ উদ্যোগ। মালয়েশিয়ার সেরি ইস্কান্দার ফার্মাসিউটিক্যাল পার্কে অত্যাধুনিক এ কারখানা গড়ে তুলতে কারিগরি সহায়তা দেয় বেক্সিমকো। এর বিনিময়ে যৌথ উদ্যোগের ৩০ শতাংশ মালিকানা পায় তারা। কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যয় বায়োকেয়ারের। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘মিটার ডোজ ইনহেলার’ প্লান্ট স্থাপন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ সনদ অর্জন করে। যৌথ উদ্যোগের এ প্লান্ট থেকে উৎপাদিত ওষুধ ২০১৭ সালেই বাজারজাত করা হয়। প্রসঙ্গত, বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের মূল অংশীদারিত্বে রয়েছে বায়োকেয়ার গ্রুপ, যা মালয়েশিয়ায় ওষুধ বিপণনে শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছে।
মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নে মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছে বেক্সিমকো ফার্মা। মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার কর্মী কিংবা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষের পাশে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু বা আহত শ্রমিকের জরুরি চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতি চালু রয়েছে এখানে।
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মায়। কর্মীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয় এখানে। তাদের সম্পদ বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার ৮০০ কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেক ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, প্রকৌশলী, এমবিএ ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা রয়েছে। কর্মীদের উন্নয়নে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। ♦