অনেক মানুষ জীবন হারিয়েছেন। হারাচ্ছেন অনেকে। সীমিত হচ্ছে সম্পদ। ইচ্ছেগুলো পাখা মেলে উড়তে পারছে না। তবে, আমাদের চিন্তাভাবনা ও কল্পনাশক্তি থেমে নেই।
কোভিডকালে আমরা উপলদ্ধি করেছি, অসীম এ ক্ষেত্রটি অতীতের মতো আর উপেক্ষিত নয়। জীবনধারণে যেসব প্রয়োজনীয়তা আমরা গভীরভাবে অনুভব করি, তার মধ্যে শিল্পকলার গুরুত্ব সর্বাধিক।
অনেকের কাছে শিল্পকলাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কেননা, যেকোনো মারাত্মক পরিস্থিতিতে শিল্পকলা আনন্দের স্বাদ এনে দেয়, এবং তা দীর্ঘস্থায়ী। বলা যায়, দুর্যোগে দিশাহারা হলেও মানবজাতির মঙ্গলের জন্য শিল্পসাহিত্যের প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরা শিক্ষকরা তাই শিক্ষার্থীদের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর মনোযোগী হতে নির্দেশনা দিচ্ছেন। ব্রিটিশ কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ও শিল্প সমালোচক জন বার্জার মানবসভ্যতা ও মানবজীবনে অনেক আগেই শিল্পকলার অনন্য অবস্থান খুঁজে পেয়েছেন।
এটা আমরা অনুধাবন করি বা নাইবা করি, সংকট ও বিচ্ছিন্নতার এ সময়ে আমাদের জীবনে শিল্পকলার ভূমিকা আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। মানবজীবনের চালিকাশক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস এ শিল্পসাহিত্য।
প্রযুক্তির কল্যানে মানুষ বিশ্বময় একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পেরেছে। করোনাকালের আগে ব্যস্ততার অজুহাতে যাদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করা থেকে বিরত থেকেছে, করোনাকালেও তাদের সঙ্গে হৃদ্যতা বেড়েছে এ ডিজিটাল জমানায়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গান, কবিতা কিংবা সাহিত্যচর্চা। এমনকি চিত্রকর্মের প্রদর্শনী, প্রচার বেড়েছে। নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখা, ইউটিউবে গান কিংবা নাটক, তথ্যচিত্র অথবা চলচ্চিত্র উপভোগ করা আগের তুলনায় সমৃদ্ধ হয়েছে এ সময়ে।
অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে একক কিংবা দলীয় চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন করেছে। এ ধারা দেখা গেছে আমাদের দেশেও। এ ধারা উর্দ্ধমুখী। একাকিত্ব কাটাতে, ভালবাসা ভাগাভাগি করে নিতে এর চেয়ে উত্তম ক্ষেত্র আর কী হতে পারে?
এটা ভাবা নিষ্প্রয়োজন যে, শিল্পকলার এসব মাধ্যম কেবল আমাদের বিনোদন দিয়েছে, বরং নৈমিত্তিক মানসিক প্রশান্তিতে সহায়কও হয়েছে। এ কারণে মনোবিদরা শিল্পকলার সমঝদার হওয়ার জন্য আহŸান জানিয়েছেন।
সীমাবদ্ধতার এ সময় আমরা টেলিভিশন, সিনেমা, বই, ভিডিও গেমস, গান ইত্যাদি ঘরে বসে উপভোগ করতে পারছি। ইচ্ছেমত কিংবা স্বাধীনচিত্তে কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়াতে পারছি, যা বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়। এ শিল্পকলাই আমাদের বিদেশের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। এ কলাই আমাদের এমন জগতের সঙ্গে মিশেল ঘটিয়ে দিচ্ছে যেখানে নিশ্চিন্তে নির্বিঘেœ অফুরন্ত সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
হলিউডের কথাই ধরুন। এখানে জম্বি, কর্পস (শব), ভাইরাস ইত্যাদির আক্রমন নিয়ে কম সিনেমা তৈরি হয়নি। ওয়ার্ল্ড ওয়ার জি, জম্বিল্যান্ড, আই অ্যাম লিজেন্ড, দি বেøয়ার উইচ প্রজেক্ট, প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি, সাম্প্রতিক সময়ের দি কোয়াইট প্লেসের মতো অসংখ্য সিনেমা তৈরি হয়েছে এখানে। এসব সিনেমার সবটাই মিলনাত্মক। তাই দর্শক এসব সিনেমার মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পাচ্ছে। অন্তত উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারছে। সঙ্গত কারনে এসব চলচ্চিত্রের দর্শক আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের সঙ্গীত ও শিল্পকলার চার অধ্যাপক বার্কলে কনভারসেশনের ভিডিও অনুষ্ঠানে শিল্পকলা ও সংস্কৃতি যে অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার উপস্থাপন করেন। চার জনের এ দলটি লুডউইগ ভন বিঠোভেন, অ্যান্টোনিও-জ্যঁ গ্রোস ও থিওডোর ভন গেরিকল্টের শিল্পকলা, ড্যানিয়েল ডিফোর সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন, যা করোনাকালে আমাদের সংগ্রামমুখর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়তা করে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অধিবাসীরা একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করেন। একটু ঘেষাঘেষি না করলে, কাছাকাছি না হলে, গায়ের উপর ঢলে না পড়লে যেন চলে না। আফ্রিকার অনেক দেশেও একই অবস্থা বিরাজ করত। ইউরোপসহ উত্তর আমেরিকার দেশগুলো কিংবা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অবশ্য কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। মনে মনে মিল থাকলেও তাদের আচার আচরণে একটু দূরত্ব কিংবা সংযত ভাব লক্ষ করা যায়। তাদের সংস্কৃতিই হয়ত কাছাকাছি বা ঘনিষ্ঠ না হতে শিখিয়েছে। একেই বলা হয় এটিকেট, যা করোনাকালে রূপ নিয়েছে সামাজিক দূরত্বে। সঙ্গনিরোধ কিংবা আইসোলেশনে থাকার অভ্যাস তাদের রয়েছে, আমাদের রয়েছে কি?
তাই, তাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা সহজ হয়েছে। কিন্ত আমরা কিংবা আফ্রিকানদের বেলায় এমনটি আশা করা বেশ দূরুহ।
সব মিলিয়ে মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থান কত উঁচুতে তা ফুটিয়ে তোলে সাহিত্য ও শিল্পকলা। ♦