কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বেড়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে গত এক বছরে বেড়েছে মোবাইল ফোন ও গ্যাজেট আসক্তি।
এর প্রভাবে কোভিডকালে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাথা ব্যথা, হাত-পা ব্যথা, ঘুম ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা বেড়েছে।
গবেষণা বলছে, এ আসক্তি শতকরা ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা বাড়িয়েছে।
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পড়ুয়া বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, মাদরাসা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশের ২১টি জেলায় এক হাজার ৮০৩ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে তারা মানসিকভাবে বিষন্ন এবং তাদের মধ্যে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া কিংবা অল্প সময়ে রেগে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা উইলির হেলথ সায়েন্স রিপোর্ট জার্নালে প্রকাশিত হয় এ গবেষণার ফল। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন।
গবেষণার তথ্য বলছে, ৬৮ ভাগ শিক্ষার্থী দিনে দুই থেকে চার ঘণ্টা ফোনে সময় কাটাচ্ছে। ৯ ভাগ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে ও আট ভাগ ট্যাবে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ সালে যেখানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ডায়রিয়া, চুলকানির সমস্যা, পেট ব্যথা, জ্বর ও সর্দি সবচেয়ে প্রকট ছিল, সেই জায়গায় গত দেড় বছরে ২০২০-২১ সালে মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তির জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্নতা ও খিটখিটে মেজাজ এবং জ্বর সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে ঘরবন্দি হয়ে থাকা ও গেজেটের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির সম্পর্ক পেয়েছেন গবেষকরা।
গবেষকরা জানান, দেশের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী শারীরিক কোনো কাজ বা খেলাধুলার অবকাশ পায়নি ২০২০ সালে এবং তাদের ৫০ ভাগ ঘরের বাইরে কোনো শারীরিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ একেবারেই পায়নি। মাত্র ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী গেজেট ব্যবহার করেছে নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের জন্য এবং ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখার কাজে, ২৭ ভাগ শিক্ষার্থী সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য এবং ১৭ ভাগ গেম খেলার জন্য গ্যাজেট ব্যবহার করেছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ও গেজেটের ব্যবহার দেখা গেছে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এবং সবচেয়ে কম দেখা গেছে মাদরাসা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে।
গবেষণায় মুখ্য তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. এসএম মাহবুবুর রশিদ ও ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিসার্চের শিক্ষক নাসরিন লিপি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আকতার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ড. আদনান মান্নান।
সহযোগী গবেষক ছিলেন জান্নাতুল মাওয়া, এমা বনিক, ইয়াসমিন আকতার, আমিনা জাহান, নাভিদ মাহবুব, মফিজুর রহমান শাহেদ ও জোবায়ের ইবনে দ্বীন।
গবেষণা প্রসঙ্গে ড. মাহবুবুর রশিদ বলেন, অতি অল্প বয়সে গ্যাজেট নির্ভরশীলতা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব সমস্যা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে দেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের একটি বড় অংশের জন্যই তা আশঙ্কার বিষয়।
গবেষক দলের অন্যতম ড. অলোক পাল বলেন, এ সমস্যাগুলো দীর্ঘায়িত হচ্ছে কি না—তা খতিয়ে দেখতে হবে। শিশুদের গ্যাজেট আসক্তি কমানোর জন্য পারিবারিকভাবে নানা উদ্যোগ প্রয়োজন।
গবেষণা পরিচালনা সহায়তায় ছিল চিটাগং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডিস সোসাইটি, দৃষ্টি চট্টগ্রাম ও ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ চট্টগ্রাম। ♦