ঘরবন্দি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে মুখিয়ে আছেন কোনো কোনো ফুটবলার। বার্সেলোনা মিডফিল্ডার ইভান রাকিতিচ যেমন যেকোনো মূল্যে মাঠে ফিরতে চান, খেলতে চান ফুটবল। স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক মার্কাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকি থাকলেও তা তোয়াক্কা করেন না তিনি।
কিছু পেশাদার ক্লাব আবার সরাসরি জরুরি এ পরিস্থিতিতে মাঠে নামার বিপক্ষে। এই যেমন নেদারল্যান্ডস তাদের শীর্ষ লিগ ইরেদিভিসির ২০১৯-২০ মৌসুম বাতিল করে দিয়েছে। ফ্রান্স সরকার তাদের লকডাউন আইন কিছুটা শিথিল করার ঘোষণা দিলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় ফুটবলের ঘরোয়া মৌসুম বাতিল করেছে।
পরিস্থিতি পুরোপুরি নিরাপদ হওয়ার আগে খেলা শুরুর বিপক্ষে আছেন আরো অনেকে।
আগে থেকেই অভিযোগ আছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাওয়ার পরও বেশ দেরিতে খেলা স্থগিত করেছে কয়েকটি দেশ। কোনো কোনো শহরে নতুন এ ভাইরাসের বিস্তারের পেছনে সবচেয়ে বড় দায় দেওয়া হয়েছে ফুটবল ম্যাচকে। বেরগামো শহরের মেয়র জর্জিয়ো জরি যেমন ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে আতালান্তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ১৯ ফেব্রুয়ারির ম্যাচকে বর্ণনা করেন, ‘বায়োলজিক্যাল বম্ব’ হিসেবে।
অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে আতলেতিকো মাদ্রিদের ১১ মার্চের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ শহরটিতে করোনাভাইরাস বিস্তৃতিতে ভূমিকা রেখেছে কী না, এ নিয়ে তদন্তের দাবি উঠেছে। ইউরোপা লিগে খেলার সময় গ্রিক ক্লাব অলিম্পিয়াকোসের মালিক এভানগেলোস মারিনাকিসের সংস্পর্শে আসার পর আর্সেনালের কোচ মিকেল আর্তেতা ও কয়েকজন খেলোয়াড় কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছিল।
তারপরও অন্য পথে হাঁটছে ফুটবলের চার পরাশক্তি জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও ইংল্যান্ড।
জার্মান বুন্ডেসলিগায় মাঠে ফেরার লক্ষ্যে এপ্রিলের শুরুতে কয়েকটি দল অনুশীলনে ফিরেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতাটির সফলতম ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখও। ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে তখন অনুশীলন করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল শিরোপাধারীরা। সবকিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা হচ্ছে বলেও নিশ্চিত করেছিল তারা। তবে সমর্থকদের অনুশীলন ক্যাম্পে আসতে নিষেধ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে এক বিবৃতিতে, ৯ মে বুন্ডেসলিগা শুরু করা হতে পারে বলে জানায় জার্মান ফুটবল লিগ। এরই মধ্যে অবশ্য শুরুর সম্ভাব্য তারিখ অন্তত এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেছে। ১৬ কিংবা ২৩ মে শুরু হতে পারে থমকে থাকা লিগটি। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দেশটির সরকার। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত আছে জার্মান ফুটবলের শীর্ষ প্রতিযোগিতাটি।
ইতালির শীর্ষ লিগ সেরি আর মৌসুম শেষ করতেও মরিয়া কর্তৃপক্ষ। ক্লাবগুলোর খেলোয়াড়রা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুশীলন শুরু করতে পারবেন আগামী মাসের শুরুতে। প্রতিযোগিতাটির ২০১৯-২০ মৌসুম শেষের নির্ধারিত সময় ছিল ৩০ জুন। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্প্রতি এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২ অগাস্ট পর্যন্ত।
অনুশীলনে ফিরতে শুরু করেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোও। যদিও প্রতিযোগিতাটি কবে নাগাদ মাঠে গড়াতে পারে, এমন কিছু এখনও জানানো হয়নি।
সবশেষ বুধবার স্পেন সরকারের পক্ষ থেকে আগামী সপ্তাহে দেশটির পেশাদার খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুশীলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মার্চে স্থগিত হওয়া ঘরোয়া ফুটবল মৌসুম জুনের শেষ নাগাদ পুনরায় শুরুর ব্যাপারে আশাবাদী স্প্যানিশ ফুটবল কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের এমন সব ভাবনা আলোচনারও খোরাক জুগিয়েছে বেশ। এই যেমন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লা লিগা আবার শুরু করতে লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেভাস যে পরিকল্পনা নিয়েছে তার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভোটাভুটি চলছে।
মার্কার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এমন কিছু জরিপের ফলও তারা জানে। যেমন, ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগে প্রাক-মৌসুমের মত খেলোয়াড়দের একটি হোটেলে রাখার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এমন ভাবনার বিপক্ষে দ্বিতীয় স্তরের লিগের একটি ক্লাবের গ্রুপে ভোট পড়েছে ২১-২।
এসব ভাবনা, পরিকল্পনা নিয়ে আগেই স্পেনের ফুটবলারদের সংগঠনে নিজেদের মত জানিয়েছেন ক্লাবগুলোর অধিনায়করা। কয়েকটি দলের কোচরাও কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন।
বার্সেলোনার কোচ কিকে সেতিয়েন যেমন এখনই মাঠে ফেরার পক্ষে নন। এপ্রিলের মাঝামাঝি এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি তা বলেছিলেন তিনি। “লা লিগার নিয়মাবলী আমি পড়েছি। আমার কাছে এগুলো সমস্যা বাড়াবে বলে মনে হয়েছে। আর এভাবে সম্ভব বলেও আমি মনে করি না।”
ইউরোপীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা উয়েফা ও বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা অবশ্য ঘরোয়া লিগগুলো শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পক্ষে।
এমন পরিকল্পনার বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন ফিফার মেডিকেল কমিটির চেয়ারম্যান মিচেল ডি’হুঘ। সম্প্রতি স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে করোনাভাইরাসকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ‘সবচেয়ে বড় দুর্যোগ’ হিসেবে উল্লেখ করে সেপ্টেম্বরের আগে ফুটবল মাঠে ফেরানো ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।
সবশেষে আবারও সেই প্রশ্ন উঠে আসে। খেলতে গিয়ে যদি একজন খেলোয়াড় আক্রান্ত হন, মাঠে নেমে যদি কাশতে শুরু করেন মেসি, যদি গলা ব্যথা অনুভব করেন রোনালদো কিংবা রবের্ত লেভানদোভস্কি বা অন্য কেউ। তখন কি ফুটবলে মহামারী ঘোষণা করা হবে?
এর অন্যতম কারণ যে অর্থ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৃহস্পতিবার অনলাইনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েলে গ্রাভিনা যেমন সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, সেরি আ বাতিলের বিপক্ষে তিনি। “মৌসুম বাতিল হলে আমরা ৭০ থেকে ৮০ কোটি ইউরো হারাব। দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হলে ক্ষতি হবে ৩০ কোটি ইউরো।”
ইংল্যান্ডের সাবেক ডিফেন্ডার গ্যারি নেভিলের মতে, আর্থিক ব্যাপার জড়িয়ে না থাকলে এই সময়ে কোনো ফুটবল হতো না। “মানুষ এখন ঝুঁকিতে আছে। ফুটবল খেলে কতজন মারা গেলে পুরো বিষয়টি অপ্রীতিকর হয়ে উঠবে। একজন? একজন খেলোয়াড়? স্টাফের একজনকে আইসিইউতে যেতে হবে? আমরা আসলে কি ঝুঁকি নিচ্ছি, কেন? পুরো বিষয়টিই অর্থনৈতিক।” ♦