মাইগ্রেন: শুধুই কি মাথাব্যথা? না কি অন্য কিছু

0

মাইগ্রেন এক বিশ্বজনীন সমস্যা। তবে মাইগ্রেন মানে কি শুধুই মাথাব্যথা? গ্রিক শব্দ এমিক্রেনিয়া থেকে এ নামটির উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে আধকপালে মাথাব্যথা। সাধারণত বেশির ভাগ মাইগ্রেন রোগীর মাথাব্যথা একদিক থেকে শুরু হয়ে পুরো মাথায় ছড়ায়।

মাইগ্রেন বহু পুরোনো একটি সমস্যা। সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগে থাকেন। মাইগ্রেন বলতে সাধারণত মাথাব্যথাকে বোঝানো হলেও এর রয়েছে আরও বেশ কিছু লক্ষণ। মাইগ্রেনের রোগীরা মাথাব্যথার সঙ্গে মাথা ঘোরানো, চোখে ঝাপসা দেখা, বমি বা বমিভাব আর আলো ও শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতাজনিত লক্ষণের কথা বলে থাকেন।

শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যাবডমিনাল মাইগ্রেন অর্থাৎ পেটব্যথা, বমি ও মাথা ঘোরানোর অভিযোগ করে, যা মা–বাবারা প্রায়ই স্কুল বা পড়াশোনার ব্যাপারে ভীতি ভেবে ভুল করেন। আবার কিছু বিশেষ ধরনের মাইগ্রেন আছে। কোনো কোনো মাইগ্রেন রোগী শুধু মাথা ঘোরানোর ব্যাপারে অভিযোগ করেন ডাক্তারের কাছে। একে বলে ‘ভেস্টিবুলার মাইগ্রেন’।

‘হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেনে’র ক্ষেত্রে শরীরের এক দিক অবশ হয়ে আসতে পারে। আবার মাইগ্রেনের জন্য চোখে কম দেখলে তাকে ‘রেটিনাল মাইগ্রেন’ বলা হয়। তবে সাধারণ অর্থে মাইগ্রেনের প্রধান লক্ষণই হলো মাথাব্যথা।

কোন বয়সের মানুষ মাইগ্রেনে বেশি আক্রান্ত হয়? সাধারণত ১০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে মাইগ্রেন হওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই মাইগ্রেনে ভোগেন বেশি। এর মাঝে পুরুষ রোগীর চেয়ে নারী রোগীর সংখ্যা বেশি।

সামনেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ সময় বহু পরীক্ষার্থী মাথাব্যথায় ভুগছে। তাদের কষ্ট লাঘবে কিছু সুচিন্তিত সমাধান রয়েছে।

পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা মাথাব্যথায় ভোগে। আর বেশির ভাগ সময় রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখা যায়, তা স্ট্রেসজনিত টেনশন–টাইপ মাথাব্যথা। কিন্তু যাদের আগে থেকেই মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে, তারা পরীক্ষার আগে এমন সময়ে বেশি ভুগে থাকে। পড়ার চাপ, পরীক্ষাসংক্রান্ত ভীতি বা দুশ্চিন্তা তো আছেই, সঠিক সময়ে ও ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করা, ঘুমের অনিয়ম বা যথেষ্ট বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণও এখানে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।

এ জন্য পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্রাম নিতে হবে। বিনোদনমূলক কিছু করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

শুধু ওষুধ নয়, গানও মাথাব্যথা উপশমে অনেক সহায়ক। রিল্যাক্স করা, রাত না–জাগা, নিজেকে পরীক্ষা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ না দেয়া উত্তম।

মাইগ্রেন কি কখনো পুরোপুরি ভালো হয়? ৪৫ বছর বয়সের পর থেকে মাইগ্রেন ধীরে ধীরে কমে আসে। সঠিক মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলে সত্যিকার অর্থেই মাইগ্রেন নিরাময় করা সম্ভব।

মাইগ্রেন চিকিৎসার আসলে দুটি পর্যায় রয়েছে। নন–ফার্মাকোলজিক্যাল পদ্ধতি অর্থাৎ ওষুধ ছাড়া জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বেশ সুফল পেতে পারেন মাইগ্রেন রোগীরা।

রোগীর নিজেকে বুঝতে হবে তার ঠিক কী কী কারণে মাথাব্যথা হয়। কারও হয়তো লম্বা ভ্রমণ, দীর্ঘক্ষণ ধরে অনাহার বা তীব্র শব্দে মাথাব্যথা করতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ‘মাইগ্রেন ট্রিগার’। পারলে এই ট্রিগারগুলো এড়িয়ে চললে মাইগ্রেন অ্যাটাক কম হবে। আর ওষুধের মাধ্যমে মেডিকেল ম্যানেজমেন্টেও মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ড্রাগস ব্যবহার করা হয়। এর একটি ভাগ হচ্ছে ব্যথানাশক বা উপশমকারী। এগুলো মাইগ্রেন প্রতিরোধ করে না। অ্যাবরটিভ থেরাপি ধাঁচের এ পেইনকিলার ওষুধগুলো বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাধারণ প্যারাসিটামল ছাড়াও টলফেন্যামিক অ্যাসিড জেনেরিক গ্রুপের টাফনিলজাতীয় ওষুধ বেশ কাজে দেয়। এ ছাড়া রয়েছে আইবুপ্রোফেন, নেপ্রক্সেনসহ নতুন আসা লাসমিডিটান গ্রুপের ও ট্রিপ্টান ধরনের ওষুধসমূহ।

এ ছাড়া মাইগ্রেন প্রতিরোধ করতে চিকিৎসক প্রয়োজনবোধ করলে রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ দিয়ে থাকেন, যা বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে দেয়া হয় এবং কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা যাবে না। কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছরও খেতে হতে পারে এ ওষুধগুলো।

সংগীত রিল্যাক্সড মুড ও বিনোদন দিতে পারে, যা মাইগ্রেনসহ সব ধরনের মাথাব্যথা উপশমে সহায়ক।

মাইগ্রেন ট্রিগার করে এমন কিছু এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো এবং তা রোগীকেই বুঝতে হবে যে কী তাঁকে ট্রিগার করছে। , কাজের চাপে মাথাব্যথা হলে তিনি কোলাহলমুক্ত কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারেন।

মাইগ্রেন যাতে না হয়, সে জন্য কী করা যায়? বংশগত বা শারীরবৃত্তীয় কারণ ঠেকানো না গেলেও পরিবেশগত কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তিনি বলেন, এ অস্থির সময়ে আমরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিই না। বিশ্রাম নেয়ার সময়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অন্যভাবে স্ক্রিনে সময় দিই। ফলে আমাদের চোখ ও মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায় না। এই ব্যাপার এখন মাইগ্রেনের এক বড় কারণ।

তরুণ প্রজন্মের যারা মাইগ্রেন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশ্রাম নিতে হবে। শুধু কাজ বা পড়াশোনা নিয়ে থাকলে চলবে না। খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক বা সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত হতে হবে। পুষ্টিকর খাবার যেমন ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে মাইগ্রেন প্রতিরোধ করা যায়।

যদি মাইগ্রেন শনাক্ত হওয়ার পর কারও সপ্তাহে একাধিকবার তীব্র মাথাব্যথা হয় এবং তা ৪৮ ঘণ্টা বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তবে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসায় যেতে হবে। এ ওষুধগুলো নিয়ম মেনে সেবন করলে ভালো ফল মেলে আর এর দামও খুব বেশি নয়।

তবে ওষুধের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করা উত্তম।

সিনেমা দেখা, গান শোনা ইত্যাদি মনকে করতে পারে আনন্দিত ও রিল্যাক্সড। মেডিটেশনও এ ক্ষেত্রে কার্যকর। তবে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ স্বরে গান, বাদ্যযন্ত্র বাজালে বা শুনলে তা থেকে মাইগ্রেন ট্রিগার করে কি না, তা–ও খেয়াল রাখতে হবে। 

Share.