চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে সংযোগকারী একটি স্নায়ু অপটিক নার্ভ। গ্লুকোমায় আক্রান্ত হলে এই স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্রমে কমে আসে দৃষ্টি। কোনো রকম জানান না দিয়েই এই দৃষ্টিঘাতী অসুখ হতে পারে। এই সমস্যা যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে যাঁদের বয়স ৪০ বছর ছাড়িয়েছে এবং বংশে যাঁদের গ্লুকোমা আছে, তাঁদের আশঙ্কা বেশি। ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে চিরতরে দৃষ্টিশক্তিও কেড়ে নিতে পারে এই রোগ।
গ্লুকোমা রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সারা বিশ্বের প্রায় আট কোটি মানুষ বর্তমানে এই অসুখে ভুগছেন। ২০৪০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা প্রায় ১১ কোটিতে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশে গ্লুকোমা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
গ্লুকোমার ধরন
বিভিন্ন অঙ্গের নিজস্ব চাপ ছাড়াও মানুষের দেহে প্রধানত তিন ধরনের তরলজনিত চাপ আছে। রক্তচাপ, সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড আর চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ (আইওপি)। চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ ২১ মিলিমিটারের বেশি থাকলে তার গ্লুকোমার আশঙ্কা বেশি। চোখের ভেতরে অতিরিক্ত চাপের কারণে অপটিক স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধীরে ধীরে কমতে থাকে দৃষ্টিশক্তি, পরিণতিতে যা অন্ধত্ব ডেকে আনে।
গ্লুকোমার লক্ষণ
গ্লুকোমায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চোখে তরল নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চোখে চাপ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন উপসর্গ তৈরি হয়। সাধারণভাবে গ্লুকোমায় চোখ লাল ভাব, পানি পড়া ও অল্প ব্যথা হয়। এই উপসর্গগুলো পরে আরও বেড়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি কমে আসে, মাথাব্যথা হয়, বমির উদ্রেক হয়। এ ছাড়া এই রোগের একটা উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো আলোর চতুর্দিকে রামধনুর ছটার (রেনবো হ্যালো) মতো দেখা। সামনের দৃষ্টি ততটা না-ও কমতে পারে, তবে পার্শ্বীয় দৃষ্টিশক্তি সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে বলে ‘টানেল ভিশন’। গ্লুকোমা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রেসবায়োপিয়া বা নিয়ার ভিশন পাওয়ারের পরিবর্তন হতে পারে।
কেন হয়
হিউমার নামক একটি তরল চোখের আকৃতি বজায় রাখতে সাহায্য করে, চোখে পুষ্টি সরবরাহ করে। চোখের জলীয় রস নিয়মিতভাবে ট্র্যাবেকুলার মেশওয়ার্ক নামক একটি টিস্যুর মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। সিলিয়ারি বডি-সংলগ্ন কর্নিয়ার গা ঘেঁষে ট্র্যাবেকুলার মেশওয়ার্কের অবস্থান। ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমায় এই নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে তরল জমা হয়ে চোখের ভেতরে বাড়তি চাপ তৈরি করে। এই উচ্চচাপ অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। তবে ইন্ট্রাঅকুলার চাপ বৃদ্ধি না পেয়েও অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে, যা স্বাভাবিক-টেনশন গ্লুকোমা নামে পরিচিত। গ্লুকোমা রোগের প্রধান কারণ চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বা ইন্ট্রাঅকুলার প্রেশার বেড়ে যাওয়া। পরিবারের অন্য সদস্যের এই রোগ থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতি স্থূলতা, চোখে আঘাত পাওয়া ইত্যাদি কারণও চিহ্নিত হয়েছে। নিওভাসকুলার গ্লুকোমা তখন ঘটে, যখন চোখ অতিরিক্ত রক্তনালি তৈরি করে, যা সাধারণত চোখের তরল নিষ্কাশনের অংশকে আবৃত করে। সাধারণত ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো কারণে এটি ঘটে থাকে। এই অবস্থা হলেও চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ হারাতে হতে পারে। এমনকি চোখের আইরিস থেকে পিগমেন্ট ঝরে গিয়ে চোখ থেকে তরল বের হতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এই অবস্থাকে বলে পিগমেন্টারি গ্লুকোমা। এ ছাড়া ছানি, টিউমারের মতো অন্যান্য কারণও গ্লুকোমা সৃষ্টি করতে পারে। যাঁরা নিয়মিত স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাঁদেরও গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ করে প্রাথমিক ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা বেশ কয়েকটি জিনের মিউটেশনের সঙ্গে যুক্ত। মোট ১৬টি মানব জিনোমিক অঞ্চল ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা এবং 8টি ক্লোজড-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার সঙ্গে যুক্ত। এসব জিন মূলত গ্লুকোমার বিকাশ ও অগ্রগতির সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের জিনগত ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। সে কারণে বাংলাদেশেও এসব জিন নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
চিকিৎসা
গ্লুকোমা পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায় না। তবে দ্রুত চিকিৎসা নিলে গ্লুকোমার কারণে হওয়া অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি বা অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা যায়। যদিও চোখের ভিজ্যুয়াল ফিল্ড বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত গ্লুকোমা রোগ শনাক্ত করা যায় না। এ রোগে তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে—চোখের ড্রপ, লেজার ও শল্যচিকিৎসা। ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমায় ‘ল্যাটানোপ্রোস্টেন বুনোড’সমৃদ্ধ একধরনের চোখের ড্রপ বেশ কার্যকর। এ ছাড়া রয়েছে ল্যাটানোপোস্ট (প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন এনালগ পরিবার) এবং অন্যান্য প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন। এগুলো মূলত চোখের ‘ট্র্যাবেকুলার মেশওয়ার্ক’ টিস্যুতে রো কাইনেজ এনজাইমকে বাধা দিয়ে তরল নিষ্কাশনের গতি বাড়ায়। এর বাইরে রয়েছে আলফা-অ্যাড্রেন্যার্জিক অ্যাগোনিস্ট, বেটা-ব্লকার ও মাস্কারিনিক রিসেপ্টর অ্যাগোনিস্ট (পিলকারপিন)।
ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার রোগীদের আজীবন চিকিৎসায় থাকতে হয়। অন্যদিকে, ক্লোজড-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার ভালো দিক হলো, এর চিকিৎসা আছে। নিরাময়মূলক লেজার চিকিৎসা গ্লুকোমার অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। গ্লুকোমার আধুনিক চিকিৎসা হলো এক্সপ্রেস শান্ট ইমপ্লান্টেশন, যাতে সফলতা অনেক বেশি ও জটিলতা অনেক কম। বাংলাদেশেও বিদেশের তুলনায় অনেক কম খরচে এমন গ্লুকোমার শল্যচিকিৎসা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য একটি চিকিৎসা হতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত অপটিক নার্ভের পুনরুদ্ধার বা অপটিক নার্ভ-সংযোজন।
গ্লুকোমা হলো চোখের রোগের একটি গ্রুপ, যা অন্ধত্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ। বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ (১২-১৮ মার্চ) একটি অনন্য উদ্যোগ, যা বিশ্বব্যাপী গ্লুকোমার ওপর আলোকপাত করে। গ্লুকোমার তাৎক্ষণিক নির্ণয় ও চিকিৎসা অপ্রয়োজনীয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করতে পারে। যেহেতু সহজে ধরা পড়ে না, তাই অনেকে জানেনই না যে তাঁদের এই রোগ রয়েছে। গ্লুকোমা সপ্তাহের মাধ্যমে প্রত্যেককে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করা হয়। বিশেষ করে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করানো জরুরি বলে পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারে গ্লুকোমার ইতিহাস থাকলে আরও সতর্ক হতে হবে। যেসব ব্যক্তির চোখে মাইনাস পাওয়ার, যাঁরা ডায়াবেটিক, যাঁদের পরিবারের কারও গ্লুকোমা আছে, বহুদিন যাঁরা স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন করছেন, তাঁরা অবশ্যই চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। গ্লুকোমা সম্বন্ধে জানুন, সচেতন হোন আর অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচুন। ♦
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
প্রফেসর ড. রাশিদুল হক সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র