গল্পের জগত আশ্চর্যময়। শিল্পচর্চার সব মাধ্যমে বড় ব্যাপ্ত এর প্রভাব। সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম ঘোষিত সিনেমায় দেখতে পাই, অজানা অচেনা নক্ষত্রসম দূরত্বে জীবন যাপনকারী অভিনয়শিল্পীর জন্য দর্শকের কান্না। অথবা উল্লাস। কখনও হা হা হি হি। এ সবই সম্ভব গল্পের বিন্যস্ততায়।
জনপ্রিয় লেখক, উপন্যাসিক ও কবি আনিসুল হক রচিত উপন্যাস ‘আমার একটা দু:খ আছে’।
এ এক উপন্যাসের ভেতর যেন বহু গল্পের সমাহার। উপন্যাসটি মনোযোগ বেশি কাড়ে এ জন্য যে, এটি এক গল্পওয়ালার কাহিনী। যে গল্পওয়ালা হওয়ার জন্য বহু রাত্রি ভোর হতে দেখা লাগে তাঁর স্রষ্টার।
আনিসুল হক তুলে আনেন খুব চেনা, আবার অলীক এক শহরকে, যার প্রতিটি গলি সরগরম ফেরিওয়ালার ডাকে। সকাল থেকে চলে রাত অবধি হাকডাক। কোনো অজ্ঞাত কারণে সে শহরে ‘বাদেম’ বলে রব তোলেন এর বিক্রেতা। দুপুরবেলায় চঞ্চল শিশুরা ঘুমায় এ জনপদে।
উপন্যাসে এমন দুপুরে এক গল্পওয়ালার প্রবেশ। শান্ত মহল্লার ধূসর রাস্তায় সে ডেকে ওঠে, ‘গল্প নেবেন গল্প! রাখবেন গল্প- গরম গল্প ভাপ ওঠা, নরম গল্প তুলতুলে, শক্ত গল্প চটাং চটাং, গল্প নেবেন গল্প, টাটকা গল্প…। ’ খুব দু:খী কিন্তু আবাহনী সে ডাক।
সাড়া না দিয়ে সম্ভব নয় এ ডাকে। বিশেষত সে শিশুদের কাছে- যাদের জানা নেই আগের প্রজন্মের শৈশব ছিল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আর ডালিম কুমারে গল্পময়। এখন যাদের সময় বন্দি হোমওয়ার্ক, হ্যান্ড ওয়ার্ক, রিমোট কট্রোল, কম্পিউটারসহ বিবিধ কিছুতে।
তাদের বাবা, মা শুধু ছুটছেন আর ছুটছেন। শিশুরা সমর্পিত গৃহপরিচারিকা, হোম টিউটর আর ডে কেয়ারে।
শহরবাসীর দরজা জানালা দুদ্দার খুলে যায় গল্পওয়ালাকে দেখার জন্য। অন্যদিকে গল্পওয়ালার টেনশন আদৌ বিক্রি হবে কি না কোনো গল্প। তাঁর ঘরে ফ্রিজ নেই। নেই আগের রাতে বানানো গল্প সংরক্ষণের ব্যবস্থা। একটি গল্পও কী বিক্রি হবে না- এ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ। না কি ফিরতেই হবে খালি হাতে?
গল্পওয়ালার ডাকে প্রথম সাড়া দেয় এক শিশু। সে শিশুকে প্রথমে ‘খোকা’ বলে ডাকেন গল্পওয়ালা। শিশু উত্তরে বলে, আমাকে ‘খোকা’ ডাকবেন না। ‘খোকা’ একজন নেতার ডাকনাম।
গল্পওয়ালার ঝুলিতে অনেক রকম গল্প। হাসির গল্প, দু:খের গল্প অনেক কিছুর সমাহার। আছে পাঁচ টাকা থেকে ষাট টাকা পর্যন্ত দামের গল্প।
প্রথম ক্রেতা হিসেবে দুই দিকে ক্র্যাচধারী শিশু ডাব্লিউ নেয় একটি পাঁচ টাকা দামের ‘মাখন রাণী’র গল্প।
সে গল্পে সংক্ষেপে জানতে পাই, এক মাখন রাণীর শাসনাধীন রাজ্য কথা। যার মাথায় একদিন আসে রাজ্যের সব মানুষকে মাখন রুটি খেতে হবে। হুকুম জারি হয়। শুধু ননী মন্ত্রী বলেন, রাজ্যের লোকেরা দুবেলা ভাত খেতে পায় না। তারা মাখন খাবে কী করে?
পরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। চলে একের পর এক কর্মসূচি। গরু মোটাতাজাকরণ, দূর্বা ঘাস উৎপাদন কর্মসূচি। বেশি গাভীর জন্য ষাঁড় বধের আয়োজন। বাদ থাকে না গরুর সংখ্যা কমানো জন্য মায়াবড়ি আমদানি প্রকল্পও। কিন্তু কোনো কিছুতে মাখন রানির নির্দেশ ফলে না। এক পর্যায়ে প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে, স্লোগান ধরে, ‘জ্বালো, জ্বালো আগুন জ্বালো।’ সে আগুনে মাখন রানি গলে নাশ হয়ে যান।
আনিসুল হক রচিত ‘আমার একটা দু:খ আছে’ উপন্যাস এমন মর্মার্থের বেশ কয়েকটি গল্পে পূর্ণ। আছে মৎস্য কুমারীর গল্প। বাদ নেই কাষ্ঠরাজার গল্প, যার সিংহাসন ঘুণে ধরে ধ্বসে পড়ে একদিন।
গল্পওয়ালার জীবনের দু:খ পাঠক মাত্রই স্পর্শ করবে। তার গরিবি বাস শহরের শেষ এলাকার এক টিনের বাড়িতে। একমাত্র পুত্র সাধন আর অসুস্থ স্ত্রী রেবাকে নিয়ে তাঁর সংসার। মহল্লার দোকানে মাস চুক্তিতে বাকির ব্যবস্থা গল্পওয়ালার। তবে এ দোকানীর নিজেরও কিছু স্বার্থ আছে।
গল্পওয়ালা তার গ্রামে থাকা স্ত্রীকে চিঠি লিখে দেয়। দোকানদার বলে, স্নেহের স্ত্রী কুলসুম পাকজনাবেষু …। গল্পওয়ালা তা লেখে, ‘প্রিয় কুসুম, কেমন আছো? গল্পওয়ালা আরও লেখে, প্রিয় কুসুম, আকাশে অনেক তারা, মেঘ নেই, নেই চাঁদও, তারার মেলায় মনে হয় কাজলা বিলে থরে থরে ফুটে আছে শাপলা শালুক। বকুল ফুলের একটা মালা তুমি দিয়েছিলে। আমি রেখে দিয়েছি। সেই শুকনো মালা থেকে আজ আসছে টাটকা সুঘ্রাণ। সে বকুলমালা বুকে জড়িয়ে আমি কেবল ভাবছি তোমার কথা কুসুম।’
গল্পওয়ালা হৃদয় চেরা ভাষায় এমন চিঠি লেখে সেই কুসুমকে যার সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। আলাপ নেই। কুসুম অশরীরীর মতো তাঁর মনে বিরাজ করে। সে কুসুম একবার শহরে চলে আসে। আবিস্কার করে তাকে চিঠি লেখা মানুষটি আর দোকানদার সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। সে তার স্বামীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে মহল্লার এক গৃহপরিচারিকার সঙ্গে লাম্পট্যের সময়ে। কুসুম ভেঙে পড়ে। তার চাই গল্পওয়ালাকে। সে মনে প্রাণে খুঁজতে থাকে গল্পওয়ালাকে।
একদিন দেখাও হয়ে যায়। গল্পওয়ালার কাছে মিনতি জানায়, তার পায়ের কাছে একটু ঠাঁই দেয়ার। গল্পওয়ালা নিরুত্তর থাকে। যদিও তাঁর দু:খের একটা নয়, বিবিধ। কারণ জানতে পাঠককে অপেক্ষা করতে হবে উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত।
উপন্যাসের এক পর্যায়ে আমরা দেখি গল্পওয়ালার উত্থান। তাঁর গল্পে সাড়া পড়ে যায় জনপদ। তুমুল বিক্রি হচ্ছে তাঁর গল্প। সে আগের মহল্লা ছেড়ে শহরে ফ্ল্যাটবাসী হয়। এখন তাঁর গল্পের কদর প্যাকেজ নাটক বানিয়েদের কাছে। এক দুগ্ধ কোম্পানি কিনে নেয় তাঁর গল্প। তাদের দুধে মিশিয়ে দেয় গল্পওয়ালার বানানো গল্প। অনেক টাকা পায় গল্পওয়ালা। কিন্তু গল্পওয়ালা পথ ভুলে যায় না। রোজ ঠিক মতোই সে নতুন নতুন এলাকায় গল্প বিক্রি করে।
শহরের চাদাবাজরা হানা দেয় তাঁর পেশায়। মিসেস নিরাপত্তা তখন ছুটে আসেন গল্পওয়ালার ফ্ল্যাটে। তবু একবার আক্রান্ত হন গল্পওয়ালা। জনসভা বস্তির এক বালিকার শুশ্রূষা পান তিনি। কিন্তু ঋণ শোধের সুযোগ মেলে না গল্পওয়ালার। তাঁর আগেই উচ্ছেদ হয় বস্তি। হারিয়ে যায় সে বালিকা।
এক সৃষ্টিশীলের যাপিতজীবন চারপাশের বাস্তবতা সমেত তুলে আনেন সৃষ্টিমান আনিসুল হক। যে শহর ও তার বাসীরা আমাদের খুব চেনা। জনপ্রিয় লেখক মানেই বাজারি ধারার নন তা সুস্পষ্ট উপন্যাসিকের বয়ানে।
‘আমার একটা দু:খ আছে’ বেদনা, উল্লাস সব কিছুর সমাহার। শুধু একটা নয়, সব দু:খ উপশমের উপাদান মহান প্রকৃতিতে রয়েছে।উপন্যাসিক ও কবি আনিসুল হক তাঁর বিপুল পাঠক গোষ্ঠিকে এই মলাটবন্দি সৃষ্টির মাধ্যমে তারই খোঁজ দিলেন মাত্র।
বইটি ছেপেছে কাকলী প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ♦
::: হাসান শাওন
লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক