বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস: দেশে মৃত্যু কমেছে ৭০ শতাংশ

0

লাতঙ্ক। একে হাইড্রোফোবিয়া কিংবা পাগলা রোগও বলা হয়। আক্রান্ত রোগী পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম হয়েছে জলাতঙ্ক। এটি প্রাণিবাহিত র‌্যাবিস ভাইরাসঘটিত রোগ, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললে চলে।

আজ (২৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব জলাতঙ্ক বা র‍্যাবিস দিবস। ২০০৭ সাল থেকেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশসহ এশিয়ার ২২টি দেশে এই দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি পালিত হচ্ছে দেশে। ‘বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২০২১’ এর এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ‘জলাতঙ্ক: ভয় নয়, সচেতনতায় জয়’।

ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ১৮৮৪ সালে জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এ মহা বিজ্ঞানী। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘বিশ্ব জলাতঙ্ক’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি পালনের লক্ষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী এই রোগের প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি।

বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যান।

অর্থনৈতিক ক্ষতি, উচ্চমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মৃত্যুহার বিবেচনায় জলাতঙ্কে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বছরে ৪ লাখের বেশি মানুষ কুকুর, বিড়াল, শেয়াল ও বানরের কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়, যাদের বেশির ভাগই ১৫ বছর বয়সের নিচের শিশু।

তবে জলাতঙ্ক নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। কুকুর ও বিড়ালে কামড় দিলে আগে গ্রামের মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসত না। যেত ঝাড়ফুঁক করা কবিরাজের কাছে। এখন সেই চিত্রের পরিবর্তন এসেছে। সেই সঙ্গে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে সরকারের টিকা কার্যক্রমের গতি বেড়েছে। ১০ বছরে জলাতঙ্কে মৃত্যুর হার কমেছে ৭০ শতাংশ।

জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির তথ্য বলছে, ২০১১ সালে সারা দেশে কুকুরের আঁচড় বা কামড়ের শিকার হন ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৪ জন মানুষ। এর মধ্যে জলাতঙ্কে মারা যান ৮২ জন। একই সময় ৪৫ হাজার ৬৫৫টি কুকুরকে টিকা দেয়া হয়।

এরপর থেকে কুকুরের জলাতঙ্ক টিকাদান বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ায় কমতে থাকে মৃত্যু।

গত বছর ২০২০ সালে ২৬ জন মারা যায় জলাতঙ্কে। সে হিসেবে ১০ বছরে জলাতঙ্কে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কেমছে।

এ বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত জলাতঙ্কে প্রাণ গেছে ১১ জনের।

এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাতঙ্কে মৃত্যু অনিবার্য হলেও এটি শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এ রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো সমাধান কুকুরে নিয়মিত জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান। সেই টিকা কার্যক্রমে গতি বাড়িয়েছে সরকার।

গবেষণা বলছে, জলাতঙ্ক আক্রান্তদের ৭০ ভাগই পুরুষ। আবার আক্রান্তদের ৪৭ ভাগ শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের কম। আক্রান্তদের ৮২ ভাগই গ্রামে থাকেন এবং ৯০ ভাগ কুকুরের কামড়ে সংক্রমিত। বিড়াল, শেয়াল ও বেজি দ্বারা সংক্রমিত জলাতঙ্কের হার যথাক্রমে ৬, ৩ ও ও ১ শতাংশ। প্রাণীর কামড়ে আক্রান্তের হার ৯৫ ও আঁচড়ে ৫ শতাংশ।

দেখা গেছে, আক্রান্তদের ৭৮ ভাগই আধুনিক চিকিৎসা নেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৯৬ শতাংশ জলাতঙ্ক সংক্রমণের জন্য কুকুর দায়ী।

কুকুর নিধন নয়, বরং তাদের গণহারে টিকা দান, অভিভাবকত্ব প্রসারণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা বেড়ে যাওয়া জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের প্রধান সমাধান।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে এ বছরের মে পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৬ লাখ ২১ হাজার ৬৪৭ জন জলাতঙ্কের চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছর মে পর্যন্ত সেবা নিয়েছেন ২৬ হাজারের বেশি। অন্যদিকে, গত দশ বছরে এই হাসপাতালে জলাতঙ্কে মৃত্যু কমেছে ৮১ শতাংশ।

২০০৯ সালে সর্বোচ্চ ১০৯ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর মারা যায় ২০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১০ সালের আগে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে হয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেন। দশ বছর পর সেই সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে এসেছে। এ বছর জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০, গত বছরে ছিল ২৬ এবং তার আগের বছর ২০১৯ সালে ছিল ৫৭ জন।

অসচেতনতা, দারিদ্র্য, রাস্তায় উদ্বাস্তু কুকুরের সংখ্যাধিক্য ও পোষা কুকুরের টিকা নিশ্চিতকরণে অবহেলার কারণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে এখনও বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১০ সালের আগে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার মানুষ জলাতঙ্কে প্রাণ হারাত। গবাদি প্রাণীর মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান এখনও অজানা। আনুমানিক সংখ্যা ২৫ হাজার, যার অর্থনৈতিক মূল্য অপরিসীম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল অপারেশন প্ল্যানের অধীন ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০২০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ কার্যক্রমের আওতায় সারা দেশে এক রাউন্ড ব্যাপক হারে কুকুর টিকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দেশের ছয়টি জেলার সব উপজেলায় তিন রাউন্ড ও ১৬টি জেলায় দুই রাউন্ড টিকার কাজ শেষ হয়েছে। এভাবে টিকাপ্রাপ্ত মোট কুকুরের সংখ্যা ২১ লখ ৩৮ হাজারেরও বেশি।

এছাড়া জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র রয়েছে ৬৭টি। এসব কেন্দ্রে প্রতিবছর বিনা মূল্যে ৪ লাখের বেশি রোগীকে টিকা দেয়া হচ্ছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করলে মানুষ ও কুকুর উভয়ই নিরাপদ থাকবে। তবে প্রাথমিক লক্ষণ দেখে কুকুরে জলাতঙ্ক সংক্রমিত হয়েছে কি না বোঝা অনেক কঠিন। এ জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই।

Share.