সৌভাগ্যের ছোঁয়ায় শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার পর বিরতির আগেই জোড়া গোল পেলেন লিওনেল মেসি। একাদশে ফেরা অঁতোয়ান গ্রিজমানও গোল করে ও করিয়ে আলো ছড়ালেন। আক্রমণভাগের জ্বলে ওঠার দিন গ্রানাডাকে উড়িয়ে লিগ টেবিলে আরেক ধাপ উপরে উঠল বার্সেলোনা।
লস কারমেনেসে গতকাল শনিবার লা লিগায় ৪-০ গোলে জিতেছে বার্সেলোনা। এ জয়ে লিগ টেবিলে তৃতীয় স্থানে উঠল রোনাল্ড কুমানের দল।
গত বছর সেপ্টেম্বরে এ মাঠে ২-০ গোলে হেরেছিল বার্সেলোনা।
মৌসুমের শুরু থেকে লিগে বারবার হোঁচট খেয়েছে বার্সেলোনা। বিশেষ করে ধুঁকছিল প্রতিপক্ষের মাঠে। হতাশার সে গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসল দলটি- এ নিয়ে টানা চারটি অ্যাওয়ে ম্যাচ জিতল।
ফ্রেংকি ডি ইয়ংয়ের ভুলে ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে গোল খেতে বসেছিল বার্সেলোনা। ডি-বক্সের বাইরে ডাচ মিডফিল্ডারের দুর্বল-ব্যর্থ পাসের পর সতীর্থের পা ঘুরে বল ধরে জোরালো শট নেন রবের্তো সলদাদো। ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান মার্ক-আন্ড্রে টের স্টেগেন।
দ্বাদশ মিনিটে সৌভাগ্যসূচক গোলে এগিয়ে যায় বার্সেলোনা। মেসির পাস ধরে তাকেই ফেরত দিতে গিয়েছিলেন সের্হিও বুসকেতস। মাঝপথে সলদাদোর পায়ে লেগে ডি-বক্সে ফাঁকা পেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় নিখুঁত শটে বল জালে পাঠান একাদশে ফেরা গ্রিজমান।
ফরাসি এ ফরোয়ার্ড অফসাইড পজিশনে থাকলেও বল প্রতিপক্ষের একজনের পায়ে লেগে আসায় গোল পায় তারা।
পাঁচ মিনিট পর দ্বিতীয় গোল পেত সফরকারীরা। গ্রিজমানের পাস পেয়ে ডান দিক থেকে উসমান দেম্বেলের শট দূরের পোস্টের একটু বাইরে দিয়ে যায়।
আথলেতিকে বিলবাওয়ের বিপক্ষে জয়ের নায়ক মেসি ৩৫তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। পাল্টা আক্রমণে মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে ডি-বক্সের বাইরে অধিনায়ককে পাস দেন গ্রিজমান। আর বল ধরে ভেতরে ঢুকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে ঠিকানা খুঁজে নেন মেসি। আক্রমণের শুরুতে বল বুসকেতসের হাতে লাগায় গোল বাতিলের আবেদন করে স্বাগতিকরা। তবে রেফারির সাড়া মেলেনি।
বিরতির আগেই আর্জেন্টাইন তারকার নৈপুণ্যে ব্যবধান আরও বাড়ে, ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ পায় বার্সেলোনা। ৪২তম মিনিটে ডি-বক্সের ঠিক বাইরে থেকে লাফিয়ে ওঠা রক্ষণপ্রাচীরের নিচ দিয়ে নেয়া ফ্রি-কিকে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন তিনি।
এবারের লিগে মেসির প্রথম ফ্রি কিক গোল, গত জুলাইয়ের পর প্রথম। লা লিগায় ফ্রি কিকে তার মোট গোল হলো ৩৭। তার অভিষেকের পর থেকে হিসেবে করলে ধারেকাছে নেউ কেউ। বর্তমানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল ১৯। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে বার্সেলোনার জার্সিতে মেসির ফ্রি কিক গোল হলো ৪৮।
রেকর্ড সাতবারের পিচিচি ট্রফি জয়ীর এবারের আসরের শুরুটা ছিল ভীষণ সাদামাটা। প্রথম ছয় রাউন্ডে মাত্র এক গোল। সেই মেসিই এখন ১১ গোল নিয়ে তালিকার চূড়ায়। এরইসঙ্গে দারুণ একটি কীর্তিও গড়া হলো তার। লা লিগার ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা ১৫ মৌসুমে ১০-এর বেশি করে গোল করলেন তিনি।
৬৩তম মিনিটে ডান দিক থেকে দেম্বেলের চিপ করে বাড়ানো বল ডি-বক্সে প্রথম ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দুরূহ কোণ থেকে নিখুঁত শটে স্কোরলাইন ৪-০ করেন গ্রিজমান। এতে জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে মেসিকে তুলে নেন কোচ।
৭৮তম মিনিটে বিপদ আরও বাড়ে গ্রানাডার; ডি-বক্সের বাইরে মেসির বদলি মার্টিন ব্রাথওয়েটকে ফাউল করে সরাসরি লাল কার্ড দেখেন হেসুস ভালেহো। প্রতিপক্ষে এক জন কম থাকার সুযোগে বাকি সময়ে অবশ্য তেমন নিশ্চিত কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি দেম্বেলে-পেদ্রিদেরও তুলে নেওয়া বার্সেলোনা।
আসরে এ নিয়ে টানা আট ম্যাচ অপরাজিত রইলো বার্সেলোনা। এর মধ্যে টানা তিনটিসহ জয় ছয়টি। ড্র দুটি। ১৮ ম্যাচে ১০ জয় ও চার ড্রয়ে বার্সেলোনার পয়েন্ট ৩৪।
১৫ ম্যাচে ১২ জয় ও দুই ড্রয়ে ৩৮ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে আতলেতিকো মাদ্রিদ।
১৭ ম্যাচে ২৪ পয়েন্ট নিয়ে সাত নম্বরে গ্রানাডা।
লিওনেল মেসি
তার পুরোনাম লিওনেল আন্দ্রেস “লিও” মেসি। জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোজারিওতে। তার বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি ইস্পাতের কারখানায় কাজ করতেন। মা সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন একজন খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। মেসির বড় দুই ভাই ও এক ছোট বোন রয়েছে।
২০০৮ সাল থেকে মেসি আন্তনেলা রোকুজ্জোর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তাদের দুটি পুত্রসন্তান রয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জুলাই মহা ধুমধামে মেসি ও রোকুজ্জোর বিয়ে হয়।
মেসি বর্তমানে আর্জেন্টিনা জাতীয় দল ও বার্সেলোনার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মেসি টানা চারবারসহ মোট ছয়বার বালোঁ দর জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, যা ফুটবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পাশাপাশি সর্বোচ্চ ছয়বার ইউরোপীয় গোল্ডেন শু জয়ের কৃতিত্বও তার।
জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে তিনি সাতশোর (৭১৯) বেশি পেশাদার গোল করেছেন। মেসি আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
মধ্য আর্জেন্টিনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা মেসি ছোট বেলায় গ্রোথ হরমোন সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হন। সে সময় আর্জেন্টিনার কোন ক্লাবের পক্ষে তাঁর চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না। বার্সেলোনা তাঁর চিকিৎসার খরচ বহনের দায়িত্ব নেয়ায় ১৩ বছর বয়সে তিনি ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এজন্য স্পেনে পাড়ি জমান।
বার্সেলোনার যুব প্রকল্পে মেসি নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেখাতে শুরু করেন। ২০০৪ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার মূল দলে তাঁর অভিষেক হয়। পেশাদার ফুটবল জীবনের শুরুতে ইনজুরি-প্রবণ হলেও, ২০০৭ সাল নাগাদ তিনি নিজেকে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেন। তিনি ২০০৭ সালের বালোঁ দর পুরস্কারে তৃতীয় ও ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পরের বছর তিনি উভয় পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। আরো পরে তিনি প্রথমবারের মত উভয় পুরস্কার জয় করেন। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তিনি বার্সেলোনার মূল দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। সে মৌসুমেই তিনি বার্সেলোনাকে প্রথমবারের মত ও প্রথম স্পেনীয় ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয়ে সাহায্য করেন।
মেসির সেরা মৌসুম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে তাঁর সেরা মৌসুম ছিল ২০১১-১২। সে মৌসুমে তিনি লা লিগা ও ইউরোপীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। বার্সেলোনার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর প্রতিভার আরেকটি ঝলক দেখা যায় ২০১৪-১৫ মৌসুেম, যখন তিনি লা লিগা ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার কৃতিত্ব অর্জন করেন ও বার্সেলোনাকে ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ট্রেবল জয়ে সাহায্য করেন।
২০০৭ সালে মেসি প্রতিষ্ঠা করেন ‘‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’’। সুরক্ষিত নয় এমন শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখে এ সংস্থা।
২০১০ সালের ১১ মার্চ মেসিকে ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত নির্বাচিত করা হয়।
২০১৩ সালের মার্চে জন্মভূমি রোজারিওতে একটি শিশু হাসপাতালে ৬০০,০০০ ইউরো অনুদান দেন মেসি। ♦