এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভোক্তারা দ্রুত ডিজিটাল কমার্স বা প্রযুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। মাস্টারকার্ডের এক গবেষণায় ভোক্তাদের দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করার চেয়ে অনলাইনে অধিক পরিমাণে পণ্য-সেবা কেনার আগ্রহ উঠে এসেছে।
আমরা যেভাবে গতানুগতিক ধারায় সশরীরে স্টোর বা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করে আসছি, তা বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন ঘটছে পণ্য-সেবার দাম পরিশোধের ধরণে। কোভিড-১৯ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরন পাল্টে দিয়েছে। এ কারণে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভোক্তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে সিনেমার ডিভিডি সব কিছুই প্রযুক্তিভিত্তিক উপায়ে অর্থাৎ অনলাইনে কেনার প্রতি ঝুঁকছেন। করোনা মহামারির পরেও ভোক্তাদের ডিজিটাল উপায়ে কেনাকাটার এ অভ্যাস স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
ভোক্তাদের মধ্যে নগদ অর্থে কেনাকাটা করার চেয়ে ই-কমার্স ও কন্ট্যাক্টলেস বা নগদবিহীন লেনদেন দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে মাস্টারকার্ডের চলমান এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান ক্রেতাদের মধ্যে ভবিষ্যত ক্রেতাদের আচরণই যেন ফুটে উঠছে।
মাস্টারকার্ডের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রোডাক্ট অ্যান্ড ইনোভেশন ডিভিসনের এক্সেকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সন্দীপ মালহোত্রা বলেন, “আমরা এখন ডিজিটাল কমার্স অর্থাৎ প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। মানুষ নিরাপত্তা ও সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পণ্য কেনা ও সরবরাহ থেকে শুরু করে টেলিমেডিসিন, কনফারেন্সের আয়োজন, ফিটনেস কোর্স, লার্নিং ও বিনোদন সব পণ্য-সেবাই নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী ঘরে বসেপেতে চান তারা।
তিনি আরও বলেন, মানুষের এ চাহিদা ও প্রত্যাশা কোভিড-১৯ শেষ হওয়ার অনেক পরেও অব্যাহত থাকবে ও তা অনলাইন বা ই-কমার্সের মাধ্যমে সম্পন্ন করার ঝোঁক ও প্রবণতা জোরালো হবে।
নিরাপদ, দ্রুত ও সহজ পদ্ধতির হাতছানি
ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে ভোক্তা ও বিক্রেতাদের মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে পণ্য কেনাবেচার ঝোঁক দ্রুত বাড়ছে। যেহেতু মানুষ সশরীরে দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করার চেয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্ডার করে ঘরে বসেই পণ্য-সেবািনিতে চায়, সেহেতু ব্যবসায়ের ধরনও পাল্টে যেতে বাধ্য। তাই এখন থেকে নতুন মনোভাবের কাস্টমার বা ভোক্তাকে ধরে রাখা ও পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের সব ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
কোভিড- ১৯ এর প্রাদুর্ভাবে মানুষের মধ্যে যেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে তেমনি সংক্রমণের ভয়, লকডাউনের প্রভাব ও ক্রেতার অভাবে অনেক স্টোর বা দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এমন কঠিন সময়েও অর্থাৎ চলতি ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডিজিটাল কমার্স বা অনলাইনভিত্তিক কেনাবেচার পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়েছে। সেলসফোর্স শপিং ইনডেক্সে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মাস্টারকার্ডের এই গবেষণায় বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ের ই-কমার্সমুখী হওয়া ও অনলাইনে লেনদেন করার বিষয়ে জোর দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ৩০ শতাংশ, ভারতে ৪৯ শতাংশ, চীনে ৫৫ শতাংশ ও জাপানে ৩৪ শতাংশ মানুষ ই-কমার্স মানে অনলাইনে কেনাকাটা করার পরিকল্পনার কথা জানান। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ৩৮ শতাংশ, ভারতে ৬৮ শতাংশ, চীনে ৫৭ শতাংশ ও জাপানে ৪০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন যে তাঁরা আজকাল স্টোর বা দোকানে গিয়ে কেনাকাটার কথা কমই ভাবছেন।
বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জনই জানান যে, তাঁরা বর্তমান করোনাকালে গতানুগতিক ধারা ছেড়ে স্থায়ীভাবে অনলাইনভিত্তিক লেনদেন করতে চান। আর প্রায় অর্ধেক ভোক্তা মনে করেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে সনাতনী পদ্ধতির লেনদেনের জায়গাটির অনেক চলে অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের দখলে।
সার্বিকভাবে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলের ৪৬ শতাংশ ভোক্তাই জানান, তাঁরা সচরাচর নগদবিহীন লেনদেন বা অনলাইনে লেনদেন সম্পাদন করে থাকে। বিভিন্ন দেশে এ হার হলো অস্ট্রেলিয়ায় ৫২ শতাংশ, ভারতে ৪৯ শতাংশ, চীনে ৪৩ শতাংশ ও জাপানে ৪১ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ার ৭১ শতাংশ, ভারতের ৭৭ শতাংশ, চীনের ৭৩ শতাংশ ও জাপানের ৬২ শতাংশ ভোক্তাই এখন বিশ্বাস করেন, গতানুগতিক ধারার জায়গায় নগদবিহীন কেনাকাটা ও লেনদেন প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মাস্টারকার্ডের গত এপ্রিলে পরিচালিত এ বৈশ্বিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ৭৯ শতাংশ ও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলের ৯১ শতাংশ ভোক্তা ডিজিটাল উপায়ে পণ্য-সেবা কিনে থাকেন। নিরাপত্তা বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী ৭৪ শতাংশ ও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৭৫ শতাংশ ভোক্তা জানান, তাঁরা করোনাকালের পরেও নগদবিহীন, অর্থাৎ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন অব্যাহত রাখতে চান।
এ বছরের শুরুর দিকে মাস্টারকার্ড বিশ্বজুড়ে ৫০টির বেশি দেশে নগদবিহীন বৃদ্ধির বিষয়ে তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। সে অনুযায়ী দেখা গেছে, মাস্টারকার্ডের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার সুবাদে ভোক্তা, দোকানী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নির্বিশেষে সবাই করোনা পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিভিত্তিক নিরাপদে নগদবিহীন লেনদেন করতে বেশি আগ্রহী।
ডিজিটাল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
কোভিড- ১৯ মহামারি শুরু হওয়ারও অনেক বছর আগে থেকে মাস্টারকার্ড সহজ উপায়ে নগদবিহীন লেনদেনের সর্বাধুনিক ধারা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়ে আসছে যাতে ভোক্তারা গতানুগতিক ধারার পরিবর্তে স্টোরে বা দোকানে গিয়ে কিংবা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কংটাক্টলেস কার্ড ও স্মার্ট ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে কেনাবেচার বিল পরিশোধ ও অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন। এ ধরনের লেনদেনের সব ক্ষেত্র যাতে উভয় পক্ষের জন্য সহজ, নির্বিঘ্ন, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত হয়, অর্থাৎ সুরক্ষিত থাকে সেটি নিশ্চিতকরণে গুরুত্ব দিয়ে আসছে মাস্টারকার্ড।
করোনা মহামারি শুরুর আগেও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি গ্রহণে প্রবল আগ্রহ দেখা গেছে। সেজন্য মাস্টারকার্ড ভোক্তাদের অধিকতর প্রযুক্তিগত সুবিধা দিতে অন্যান্য ডিজিটাল পণ্যও নিয়ে এসেছে। মাস্টারকার্ড বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও বাজারের ব্যবসায়িক, আর্থিক ও প্রযুক্তিক প্রতিষ্ঠান এসব পার্টনার বা অংশীদারদের সঙ্গে মিলে কাজ করার মাধ্যমে ভোক্তাদের জন্য লেনেদেন করার মানসম্পন্ন কার্ডসেবা নিশ্চিত করেছে। এ লক্ষে নেওয়া ডিজিটাল কার্ড কর্মসূচির আওতায় মাস্টারকার্ড সিঙ্গাপুর ও ফিলিপিনসের গ্র্যাবপে, হংকংয়ের ভার্চ্যুয়াল ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মক্স ও উইল্যাব ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করেছে।
পরিবর্তিত ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে ছোট-বড় সব আকারের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্যই ই-কমার্স, পেমেন্টস, সাইবার নিরাপত্তা, জালজালিয়াতি রোধ, ডেটা বা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে সলিউশনস বা সমাধান ও সেবা রয়েছে মাস্টারকার্ডের।
ভারতে সম্প্রতি মাস্টারকার্ড, অ্যাক্সিস ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ডলাইন সফট পিওএস (পয়েন্ট-অব-সেলস) চালু করেছে। এটি একটি অ্যাপ যার মাধ্যমে স্মার্টফোন পয়েন্ট-অব-সেলসে (পিওএস) পরিণত হয়। বদৌলতে ব্যবসায়ী-ভোক্তা নির্বিশেষে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে নগদবিহীন লেনেদেন সম্পন্ন করতে পারেন। সাশ্রয়ী এ সেবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও কোনো পিওএস ডিভাইসে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রাখে ও নানা ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে তাঁরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়যোগ্য পণ্য-সেবার ক্যাটালগ বা মূল্যতালিকা দেখতে পান, সে অনুযায়ী অর্ডার দিতে পারেন ও একইভাবে ব্যবসায়িক ঋণও নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি লেনদেনের তথ্য রেকর্ড রাখা যায়।
সন্দীপ মালহোত্রা বলেন, ‘বর্তমান সময়টা সবার জন্যই বেশ চ্যালেঞ্জের। এ সময়ে আমরা পণ্য-সেবা উদ্ভাবন ও পরিবর্তন আনয়নে জোর দিয়েছি, যা আমাদের সবার মনোবল শক্তিশালী করবে। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতটা হবে ডিজিটাল অর্থনীতির। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আগামীতে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা উভয়েই ডিজিটাল বিপ্লব-বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবেন। বর্তমানে মানুষ ডিজিটাল উপায়ে সহজে, নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে নগদবিহীন লেনদেনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন এবং এই ধারা আরো জোরদার হবে এমনটাই আশা করছেন। এই প্রবণতা থেকে মানুষ পেছনে ফিরে যাবে না, বরং সামনের দিকেই এগিয়ে চলবে।
মাস্টারকার্ড গত ২৭ এপ্রিল থেকে ১৭ মে পর্যন্ত এ জরিপ পরিচালনা করে। এতে ১৫ দেশের ৬ হাজার ৭৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মত নেওয়া হয়। দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, স্পেন, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
মাস্টারকার্ড
মাস্টারকার্ড হচ্ছে বিশ্বব্যাপী একটি আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন নেটওয়র্ক মাস্টারকার্ডের। প্রতিষ্ঠানটি ২১০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে ভোক্তা বা গ্রাহক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী, সরকার ও ব্যবসায়ীদের সেবা দিয়ে থাকে। মাস্টারকার্ডের পণ্য ও সেবা বিশ্বজুড়ে সব মানুষের জন্য দৈনন্দিন কেনাকাটা, ভ্রমণ-পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ও অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কর্মকান্ডকে অধিকতর সহজ, নিরাপদ ও কার্যকর করে তুলেছে। ♦