টিকায় তৃতীয় প্রান্তিকে লাভ বেড়েছে বেক্সিমকোর

0

মহামারীর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের লাভ বেড়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর একটি অংশ কভিড-১৯ টিকা সরবরাহ থেকে এসেছে বলে কোম্পানি তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় এ ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানি গতকাল রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) জানিয়েছে, এ প্রান্তিকে তাদের শেয়ার প্রতি আয় বেড়ে ৩ টাকা ২৮ পয়সা হয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ২ টাকা ০২ পয়সা ছিল।

বেক্সিমকো ফার্মা বলেছে, তাদের এ লাভের কিছু অংশ এসেছে ভারত থেকে করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশ সরকারের কাছে সরবরাহ করার মাধ্যমে। পাশাপাশি রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাও ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকার ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মা।

সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে গতবছর শেষ দিকে ত্রিপক্ষীয় যে চুক্তি হয়, সেখানে বেক্সিমকো ফার্মাও ছিল।

ওই চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত মাশুলের বিনিময়ে আমদানি, সংরক্ষণ ও দেশের নানা স্থানে সরকারের ওষুধ সংরক্ষণাগারে পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।

অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করে সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে তাদের নিট আয় হয়েছে ৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

ডিএসইতে বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দাম ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বাড়তে দেখা গেছে। টানা তিন দিন ধরে এ কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ছে।

সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে সরকার এ পর্যন্ত হাতে পেয়েছে ৭০ লাখ ডোজ। ছয় মাসের মধ্যে সব টিকা আসার কথা থাকলেও ভারত এখন রপ্তানি বন্ধ রাখায় ফেব্রুয়ারির পর আর কোনো চালান আসেনি।

-বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস-
বাংলাদেশের ওষুধ রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউক্যিালস লিমিটেড।

সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে উন্নত ও আধুনিক ওষুধ সরবরাহ করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটি ‘বেক্সিমকো ফার্মা’ নামে সমধিক পরিচিত।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ ও ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ।

বেক্সিমকো ফার্মায় বর্তমানে ৫০০’র বেশি ক্যাটাগরির ওষুধ রয়েছে। মানবদেহের উপকারী ও সুস্বাস্থ্যের বিধানে নানা ধরনের ওষুধ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। উৎপাদনের সব পর্যায়ে বৈশ্বিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয় এখানে। ওষুধ তৈরিতে শতভাগ মান নিশ্চিত করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে। সেরা মানের সঠিক পণ্য তৈরি করে থাকে তারা। দেশ ও দেশের বাইরের গ্রাহক চাহিদা প্রাধান্য দেয়া হয় এখানে। সংগত কারণে আস্থা অর্জনের পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরিণত হয়েছে সফল ফার্মাসিউটিক্যালসে।

১৯৭৬ সালে উৎপাদনে আসে বেক্সিমকো ফার্মা। মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৮০ সালে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওষুধ তৈরি শুরু করে। ১৯৮৩ সালে নিজস্ব ফরমুলেশন ব্র্যান্ড চালু করে।

১৯৮৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে ওষুধের উপকরণ (এপিআই) প্রস্তুত শুরু করে। ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় ফরমুলেশন পণ্য বিক্রি শুরু করে। প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৩ সালে অ্যান্টি-রিট্রোভাইরাল (এআরভি) ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। ২০০৫ সালে প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের (এলএসই) অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে (এআইএম) তালিকাভুক্ত হয়। ক্লোরোফ্লোরো কার্বনমুক্ত এইচএফএ ইনহেলার চালু করে। এ ধরনের ইনহেলারের প্রবর্তন শুরু হয় বেক্সিমকোর কল্যাণে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মেনে চলে বেক্সিমকো ফার্মা। মেডিক্যাল ডিভাইস উৎপাদনে গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়। তাই অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের নানা মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জিসিসিভুক্ত দেশ, ব্রাজিল, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ।

বেক্সিমকো ফার্মা ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার থেরাপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (টিজিএ) জিএমপি অ্যাক্রিডিটেশন সার্টিফিকেট পায়। একই বছরে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর গালফ সেন্ট্রাল কমিটি ফর ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অ্যাক্রিডিটেশনও অর্জন করে। পরের বছর ব্রাজিলের জিএমপি অনুমোদন পায়।

২০১০ সালটি বেক্সিমকো ফার্মার জন্য একটি মাইলফলক বলা যায়। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটির নানা ওষুধ।

২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার জিএমপি অ্যাক্রিডিটেশন পায়। প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে সালবুটামোল এইচএফএ ইনহেলার রফতানি করে। ২০১৩ সালে ইউরোপের বাজারে চক্ষুসংক্রান্ত পণ্য রফতানি শুরু করে। ২০১৪ সালে তাইওয়ানের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএফডিএ) ও হেলথ কানাডার জিএমপি অনুমোদন লাভ করে। ওই বছর অস্ট্রেলিয়া ও রোমানিয়ায় ওষুধ রফতানি শুরু হয় তাদের।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) জিএমপি অনুমোদন পায়। ওই সময় কুয়েতের বাজারে প্রবেশ করে তারা। পঞ্চমবারের মতো ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি (গোল্ড) অর্জন করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মালয়েশিয়ার বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওষুধ তৈরির কারখানা নির্মাণ করে। বাংলাদেশের বাইরে এটিই বেক্সিমকোর প্রথম যৌথ উদ্যোগ। মালয়েশিয়ার সেরি ইস্কান্দার ফার্মাসিউটিক্যাল পার্কে অত্যাধুনিক এ কারখানা গড়ে তুলতে কারিগরি সহায়তা দেয় বেক্সিমকো। এর বিনিময়ে যৌথ উদ্যোগের ৩০ শতাংশ মালিকানা পায় তারা। কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যয় বায়োকেয়ারের। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘মিটার ডোজ ইনহেলার’ প্লান্ট স্থাপন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ সনদ অর্জন করে। যৌথ উদ্যোগের এ প্লান্ট থেকে উৎপাদিত ওষুধ ২০১৭ সালেই বাজারজাত করা হয়। প্রসঙ্গত, বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের মূল অংশীদারিত্বে রয়েছে বায়োকেয়ার গ্রুপ, যা মালয়েশিয়ায় ওষুধ বিপণনে শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছে।

মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নে মানুষের কল্যাণে নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছে বেক্সিমকো ফার্মা। মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার কর্মী কিংবা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষের পাশে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু বা আহত শ্রমিকের জরুরি চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রভৃতি চালু রয়েছে এখানে।

প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মায়। কর্মীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয় এখানে। তাদের সম্পদ বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার ৮০০ কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেক ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, প্রকৌশলী, এমবিএ ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা রয়েছে। কর্মীদের উন্নয়নে নানা সময় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

Share.