এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে তফাত, বাংলাদেশে তা মুছে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়। সেইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন বিপদ। মৌসুম হোক বা না হোক, ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে শহরে।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে।
জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে জনস্বাস্থ্যের ওপর এরই মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোয় তা আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে শূন্য দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য।
প্রতিবছর গ্রীষ্মের সময়টা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে গরম। ক্যালেন্ডারে যে সময়টায় শীত থাকার কথা, তখনও তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি থাকছে।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো আগে, সেই জুন-আগস্ট মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এর ফল হচ্ছে অন্যরকম। এ সময়টায় যেসব রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেয়, তা আরও বেশি সময় ধরে ছড়ানোর মতো উপযুক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টির পরিবেশ পাচ্ছে।
দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে পুরো বিশ্বে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি এক দশকে দ্বিগুণ হচ্ছে।
বর্ষাকালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে সংক্রামক রোগের প্রবণতা ১৯ দশমিক সাত শতাংশ কমে আসে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য।
এসব রোগে প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হন, তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকালে, আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। এর মানে হলো বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য বাড়লে এসব রোগের মৌসুমও দীর্ঘ হবে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই বছরের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অর্ধেকই ঢাকার। আর ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল সারাদেশের ৭৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারী বর্ষণের সঙ্গে পরের মাসগুলোর অনুকূল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রাখে। আর আবহাওয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোয় বর্ষাকালে ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আবার শুকনো মৌসুমে এসব শহরে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূল ভূমিকা রাখছে বায়ুদূষণ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ও আর্দ্র্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উদ্বেগে ভোগার প্রবণতাও বেড়ে যায়। আর গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়ে বেশি। নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি মাত্রায় উদ্বেগে ভোগেন।
জলবায়ু বদলে যাওয়ার প্রবণতা যত দ্রুত হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবও ততই বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা এক দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে দুই দশমিক চার ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে ৭৪ মিলিমিটার।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অবস্থা যদি সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি চার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এতটাই চাপ পড়বে যে খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণা তখন আর কোনো কাজে আসবে না।
এমন পূর্বাভাস সামনে রেখে চার ধরনের সুপারিশ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে।
প্রথমত, স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে আরও মনোযোগ দিতে হবে, সেইসঙ্গে বাড়াতে হবে মৌসুমি রোগের বিস্তারের ওপর নজরদারি। সেজন্য আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি বা পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয় বাসিন্দদের আরও বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
চতুর্থত, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এমনিতে যেহেতু হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেহেতু এখনও এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ♦