বাংলাদেশে প্রতি বছর দেশে কমপক্ষে ১৩ থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। গত এক যুগে প্রকাশিত নানা গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে আত্নহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখে কমপক্ষে ৭.৮ থেকে ৩৯.৬ শতাংশ।
নানা সংস্থার রিপোর্টে বোঝা যায়, দেশে আত্মহত্যা হার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশে আত্মহত্যার সঠিক হার নির্ণয় না করা গেলেও গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের ও কমবয়সী তরুণদের মধ্যে আত্নহত্যার হার বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বাংলাদেশি গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অন্তত প্রতি দশ জনে একজন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যাকে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অনেকে জানেন না যে আত্মহত্যার পূর্বাভাস কৈশোরে পাওয়া যায় এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে কি না তা বোঝার মাধ্যমে।
তিনটি বিষয়ের কোনো একটি যদি কারও মধ্যে থাকে, তাহলে তার আত্মহত্যা প্রবণতা আছে বলে ধরে নেয়া যায়।
১) আত্মহত্যার চিন্তা
২) আত্মহত্যার পরিকল্পনা
৩) আত্মহত্যার চেষ্টা
গবেষণা বলে, সারাবিশ্বে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের প্রতি ছয়জনে অন্তত একজনের মাঝে এ তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটি রয়েছে। কৈশোরে আত্মহত্যা প্রবণতা থাকা যেমন ভবিষ্যতে আত্মহত্যা করাকে ইংগিত করতে পারে, তেমনি এটি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নানা মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। আবার বিভিন্ন মানসিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাও একজনের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
সন্তানের সামাজিক, আবেগিক ও মানসিক বিকাশে তার সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জীবনে চলার পথে নানা চাপ ও দুর্ঘটনা সামাল দিতেও এ বিষয়গুলো ভূমিকা রাখে। কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কে চারটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
১) মানসিক সহযোগিতা বা সন্তানের সমস্যা বুঝতে পারা
২) সন্তানের পড়াশোনার খোঁজখবর রাখা
৩) সন্তান অবসরের কাজকর্মের খোঁজখবর রাখা
৪) সন্তানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করা
বিষয়গুলো ‘প্যারেন্টিং স্কিল’ বা সন্তান লালনপালনে দক্ষতার অংশ। যেসব সন্তানের কৈশোরে বাবা-মায়ের মাঝে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের (যেমন ডিভোর্স বা সেপারেশন) বা তাদের থেকে মানসিক দূরত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
অন্যদিকে, বাবা-মায়ের সঙ্গে ইতিবাচক ও সুসম্পর্ক কৈশোরে বিষন্নতা ও উদ্বেগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়, যা পক্ষান্তরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্নহত্যার প্রবণতা তৈরি হওয়া প্রতিরোধ করে।
কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের সম্পর্ক কীভাবে এবং কতটা আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে জড়িত তা নিয়ে বিশ্বে বড় পরিসরে কোন গবেষণা হয়নি। লাইফস্প্রিং লিমিটেডের গবেষকরা এ বিষয়টি বোঝার জন্য সম্প্রতি ৫২টি দেশের ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১,২০,৮৫৮ জন কিশোর-কিশোরীদের মাঝে পরিচালিত জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। তাদের মধ্যে মোট ৫৩.৯% ছিল মেয়ে। জরিপের এ তথ্য নেয়া হয়েছে গ্লোবাল স্কুল বেজড হেলথ সার্ভের ডেটাবেজ থেকে।
আফ্রিকা মহাদেশের ৮টি দেশ, আমেরিকার ১৫টি, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ৭টি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬টি ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৬টি দেশে পরিচালিত জরিপের তথ্য এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ২,৫৪৫ জন কিশোর-কিশোরীদের তথ্যও এ বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষণার ফল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত ই ক্লিনিক্যাল মেডিসিন নামক ওপেন-অ্যাকসেস পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, ৫২টি দেশে সামগ্রিকভাবে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ কিশোর-কিশোরী মনে করে, বাবা-মায়েরা তাদের সমস্যা বুঝতে পারেন। দেশভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সন্তানের সমস্যা বুঝতে পারার এ হার সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে, যেখানে প্রায় ৬১% কিশোরী বলেছে যে বাবা-মায়েরা তাদের সমস্যা বোঝেন।
বাংলাদেশে ৪২.৭% কিশোরও ৫৫.৩% কিশোরী মনে করে যে বাবা-মায়েরা তাদের সমস্যা বোঝেন। সব অঞ্চল বিবেচনা করলে সামগ্রিকভাবে অর্ধেকের চেয়েও কম কিশোর-কিশোরীদের বাবা-মা তাদের পড়াশোনা ও অবসর সময়ের খোঁজখবর রাখেন। তবে বাংলাদেশে পড়াশোনায় খোঁজখবর রাখার হার অর্ধেকের চেয়ে কিছু বেশি (ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫২.৯% ও মেয়েদের ৫৬.৬%)।
অন্যদিকে, ছেলেদের (৪১.৫%) তুলনায় বাবা-মায়েরা তাদের মেয়েদের (৪৯.১%) অবসর সময়ের ক্রিয়াকলাপের খোঁজখবর বেশি রাখেন। সামগ্রিকভাবে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্মান করে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি বাবা-মা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের বাবা-মায়েদের মধ্যে এ হার তুলনামুলক কম হলেও বাংলাদেশের বাবা-মায়েদের মধ্যে সন্তানের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্মান করার হার বেশি (ছেলেদের ক্ষেত্রে ৮৪.৯% এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮৮.৯%)।
আরও জানা গেছে, সামগ্রিকভাবে কিশোর বয়সের মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সমবয়সী ছেলেদের চেয়ে বেশি। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কিশোর-কিশোরীদের দের মধ্যে এই প্রবণতা কম। বেশি আফ্রিকান অঞ্চলে।
ছেলে আর মেয়েদের তুলনা করলে দেখা যায়, ধনী দেশগুলোর ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতার হার সবচেয়ে বেশি এবং দরিদ্র দেশগুলোর মেয়েদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের দের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রায় সমান, যথাক্রমে ১১.৬% ও ১১.৭%।
বাবা-মায়ের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্কের যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে কৈশোরে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকার বিষয়টি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেসব কিশোর-কিশোরী মনে, বাবা-মায়েরা তাদের বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে যে কোনো ধরনের আত্মহত্যা প্রবণতা (চিন্তা, পরিকল্পনা, চেষ্টা) থাকার হার কম।
আফ্রিকা বাদে অন্য সব অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদের সন্তানের সমস্যা বুঝতে পারা, পড়াশোনা ও অবসরে খোঁজখবর রাখার শক্তিশালী সম্পর্ক থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সম্মান করার সঙ্গে তাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতার সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
কৈশোরে আত্মহত্যা প্রবণতা ও বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর পরিবারের আর্থসামাজিক, মনোসামাজিক বা জীবনযাপনের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব গবেষণায় পাওয়া যায়নি। এর মানে হচ্ছে, বাবা-মায়েরা যে অবস্থানে যেভাবেই থাকুন, তাদের সন্তানকে বুঝতে পারা এবং তাদের পড়াশোনা ও অবসর সময়ের খোঁজখবর নেয়া সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক।
এ গবেষণা দলের নেতৃত্বে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েদুল আশরাফ বলেন, “প্যারেন্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা অনেকেই এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নই। প্রত্যেক বাবা-মায়েরই গুড প্যারেন্টিং স্কিলগুলো জানা থাকা উচিত এবং ফলো করা উচিত, যাতে আমরা আমাদের সন্তানদের আরও ভালোভাবে বড় করে তুলতে পারি। আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণাটির ফলাফল থেকে এই বিষয়টিই প্রমাণিত হয়েছে।”
গবেষণা দলের আরেক সদস্য লাইফস্প্রিং লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সাইকোলজিস্ট ইয়াহিয়া আমিন বাবা-মায়েদের উদ্দেশ্যে বলেন, “একদিকে যেমন এটা সত্যি যে বাবা-মায়ের উপকারী ভূমিকা শিশুদের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, একইভাবে বাবা-মার কিছু ভুল কাজ, ক্ষতিকর কাজ বা কথা তাদের বাচ্চাদের জন্য সারাজীবনের একটা ট্রমা হতে পারে বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। নিজেদের সন্তানের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ন যেন তার জন্য সবচেয়ে বড় হারানোর বিষয়টা যেন থাকে আপনার সাথে তার সম্পর্ক।”
বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের এবং বাবা-মায়ের সম্পর্কের ধরণও ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে দেশ ও জাতি নির্বিশেষে, একজন কিশোর বয়সী সন্তান এটা যতটা বুঝতে পারবে যে তার বাবা-মা তার সমস্যাগুলো বুঝেন, তার পড়াশোনা ও অবসর সময়ের খোঁজ রাখেন এবং তার নিজস্ব গোপনীয়তাকে সম্মান করেন, ততটাই তার মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কম থাকবে। ♦