ইসলামী বন্ড সুকুকের দ্বিতীয় নিলামের তারিখ ঘোষণা

0

চার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহে শরিয়াহিভত্তিক সুকুক বন্ডের নিলামের তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ৯ জুন দ্বিতীয়বার নিলামটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম দফায়ও চার হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ইস্যু করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পাঁচ বছর মেয়াদি এ বন্ডে বিনিয়োগ থেকে পাওয়া যাবে বার্ষিক চার দশমিক ৬৯ শতাংশ মুনাফা। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ নিলামে অংশ নিতে পারবে।

নিলামের দিন সকাল ১০টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইসলামিক সিকিউরিটিজ সেকশনের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে আগ্রহীদের। নিলাম চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। নিলামে প্রস্তাব দাখিলে আগ্রহীরা ১০ হাজার টাকা ও এর গুণিতক যে কোনো অঙ্কের বন্ড কিনতে পারবেন।

নিলামের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদি চার হাজার কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের সুকুক ইস্যু করা হবে, যার মেয়াদ হবে ২০২৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিডে কৃতকার্য বিডারদের আবেদনের বিপরীতে বরাদ্দ সুকুকের পরিমাণ একই দিন ই-মেইল দিয়ে অবহিত করা হবে। অকশন-পরবর্তী কার্যদিবসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত আল-ওয়াদিয়াহ বা চলতি অ্যাকাউন্ট ডেবিট এবং সিকিউরিটিজ হিসাব ক্রেডিট করে এ লেনদেন সম্পন্ন করা হবে।

দেশে প্রথমবারের মতো শরিয়াহিভত্তিক সুকুক বন্ড বাজারে ছেড়েছে সরকার। ইসলামি এ বন্ড থেকে দ্বিতীয় দফায় আরও চার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। সুকুকের টাকা ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ বাস্তবায়নে অর্থায়ন করা হবে।

জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সারাদেশে পানি সরবরাহ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে আট হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীদের টাকায় গড়ে ওঠা এ প্রকল্প থেকে পানি কিনবে সরকার। এ থেকে নির্ধারিত হারে মুনাফা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। প্রকল্প শেষে বিনিয়োগকারীদের মূল টাকা ফেরত দেয়া হবে। অন্য সব সরকারি বন্ডের মতো সুকুক বন্ডের বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসএলআর সংরক্ষণ করা যাবে।

এর আগে প্রথম ধাপে এ প্রকল্পের জন্য চার হাজার কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) ইজারা সুকুক ইস্যু করা হয়েছিল ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর।

সুকুক
‘সুকুক’ আরবি শব্দ। এর অর্থ, সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেয়ার আইনি দলিল। তবে প্রচলিত বন্ড ও ‘সুকুক’ বন্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত বন্ড সুদভিত্তিক হওয়ায় তা শরিয়াহসম্মত নয়। আর ‘সুকুক’ হচ্ছে এমন একটি বিনিয়োগ, যাতে সম্পদের ওপর মালিকানা দেয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন ও মুনাফা পান।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন থেকে প্রচলিত ট্রেজারি বিল ও বন্ড এবং সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি শরিয়াহভিত্তিক এ বন্ডও হবে সরকারের অর্থ সংগ্রহের নতুন একটি উত্স, যে অর্থ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা হবে।

সরকারের সুবিধা: বাজেটে ঘাটতি মেটাতে এত দিন সরকার শুধু প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে পারত। অথচ দেশের এক-তৃতীয়াংশ ইসলামী ব্যাংকিং। শরিয়াহভিত্তিক উপকরণ না থাকায় সেখান থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছিল না সরকার। ইসলামী বন্ডের কল্যাণে এখন সেখান থেকেও ঋণ নেয়ার সুযোগ তৈরি হলো। এতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আসার পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরতা কমবে। সে সঙ্গে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয়ও কমবে।

ইসলামী ব্যাংকের সুবিধা: প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মধ্যে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর সুবিধাই বেশি হবে। কারণ এ বন্ড চালুর ফলে পড়ে থাকা অলস টাকা বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর। এতে তাদের মুনাফাও বাড়বে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) সংরক্ষণও সহজ হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সুবিধা: বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন তার রেপো ও রিভার্স রেপো কার্যক্রম প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারলেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করা সম্ভব ছিল না। ফলে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন ‘সুকুক’ বন্ডের কারণে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে এ ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাধারণ মানুষের সুবিধা: অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা সুদের ব্যাপারে আগ্রহী নন। ফলে তারা টাকা এমনিই ফেলে রাখেন। ‘সুকুক’ বন্ড শরিয়াহ পরিপালন করে ইস্যু হওয়ায় এখানে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। এছাড়া যারা সুদভিত্তিক কারবার করেন, তাদেরও এ বন্ডে বিনিয়োগে বাধা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুদারাবা (মুনাফায় অংশীদারি), মুশারাকা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগি), মুরাবাহা (লাভে বিক্রি), ইশতিসনা (পণ্য তৈরি), করজ হাসান (উত্তম ঋণ), সালাম (অগ্রিম ক্রয়) ও ইজারা (ভাড়া) ‘সুকুক’ প্রচলিত আছে।

দেশে দেশে সুকুক
ব্যাংকাররা আরও জানান, সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। এছাড়া বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও সুকুক প্রচলিত রয়েছে। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অমুসলিম দেশেও এখন সুকুক চালু রয়েছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থমসন রয়টার্সের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা ‘বৈশ্বিক ইসলামি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন’ অনুযায়ী ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামি অর্থায়নের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ কোটি মার্কিন ডলার। বলা হয়, ইসলামি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এতই ইতিবাচক যে ২০২১ সালেই তা সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। বাংলাদেশি ব্যাংকাররা বলছেন, এ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারলে বাংলাদেশের ভালো হবে।

Share.